মসলিনের প্রাণ ফুটি কার্পাস

কাপাসিয়ার হাইলজোর গ্রামের বেলায়েত মাস্টারের বাড়িতে ফুটি কার্পাসের ফুল
ছবি: লেখক

মসলিন শুধু আমাদের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের অংশই নয়, অনন্য ঐতিহ্যের সোনালি এক অধ্যায়ের নামও। একসময় ইউরোপের বাজারে তুমুল আলোড়ন সৃষ্টিকারী এই পণ্যের যতটা আকস্মিকভাবে আবির্ভাব, আবার ততটাই হঠাৎ করে হারিয়ে গেল লোকচক্ষুর আড়ালে।

মাত্র কয়েক বছর আগে আবার আলোচনায় এল বিষয়টি। সরকারের পক্ষ থেকে পুনরায় মসলিন তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হলো। প্রায় পাঁচ বছরের প্রাণান্ত চেষ্টায় গবেষকেরা অবশেষে সফল হন। সংশ্লিষ্ট তথ্যে জানা যাচ্ছে, ১৮৫০ সালে লন্ডনে ঢাকাই মসলিনের সর্বশেষ প্রদর্শনী হয়। সেই প্রদর্শনীর ১৭০ বছর পর নারায়ণগঞ্জের দুজন তাঁতি সেই নকশা দেখে হুবহু একটি মসলিন শাড়ি বুনতে সক্ষম হন ২০২০ সালে। এর মধ্য দিয়ে আমাদের লুপ্ত ঐতিহ্য আবার ফিরে আসে।

কিন্তু এই সুবিশাল কীর্তির মূল শক্তি যে একটি উদ্ভিদজাত ফল, সে কথা স্মরণ করিয়ে দিলেন বৃক্ষপ্রেমী, লেখক ও সংসদ সদস্য সিমিন হোসেন রিমি। আরও কিছু চমকপ্রদ তথ্যও দিলেন তিনি। জানালেন, নিজের উপজেলা গাজীপুরের কাপাসিয়ায় গেলেই পাওয়া যাবে সেই মূল্যবান ফুটি কার্পাসের কয়েকটি গাছ। আবার এই কার্পাসগাছ থেকেই যে কাপাসিয়ার নামকরণ, তার সপক্ষেও কিছু ঐতিহাসিক সূত্রের কথা বললেন সিমিন হোসেন। একসঙ্গে এতগুলো বিষয় মনকে অস্থির করে তুলল! অদৃশ্য এক শক্তি আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে যেতে চাইল কাপাসিয়ার সেই গ্রামে।

মধ্য–জানুয়ারির দেশকাঁপানো জবুথবু শীতের এক সকালে কাপাসিয়ার উদ্দেশে বেরিয়ে পড়ি। কাপাসিয়ার আমরাইদ বাজারে দেখা হলো প্রকৃতিপ্রেমী তরুণ উদ্যোক্তা মাসুম খানের সঙ্গে। তিনিই আমাকে নিয়ে যাবেন সেই পুরোনো কার্পাসগাছটির কাছে। এই মধ্যদুপুরেও সূর্যদেব ঘুমিয়ে আছেন। কিছুক্ষণের মধ্যে আমরা পৌঁছে গেলাম হাইলজোর গ্রামে গাছটির কাছে। বেশ কয়েকটি বিক্ষিপ্ত ডালপালা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে গাছটি। পাশেই তুলা উন্নয়ন বোর্ডের একটি নামফলক। বোঝা গেল, গাছটি সংরক্ষণের চেষ্টা চলছে।

প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো স্থানীয় এই বিস্মৃতপ্রায় ও বিপন্ন উদ্ভিদটি কীভাবে আবার খুঁজে পাওয়া গেল, তারও একটি সংক্ষিপ্ত ইতিহাস আছে। জানা যায়, নতুনভাবে মসলিন তৈরির কর্মযজ্ঞের সময় গাছটির সন্ধান শুরু করেন প্রকল্প–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার এক শিক্ষার্থীকে দিয়ে গাছটির ছবি আঁকানো হয়। সেই ছবি দিয়ে খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমও গাছটির সন্ধান চেয়ে তাঁর ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেন।

এসব দেখে গাজীপুরের কাপাসিয়ার একটি কলেজের অধ্যক্ষ মো. তাজউদ্দিন ফুটি কার্পাসের সন্ধান চেয়ে স্থানীয় বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রচারপত্র বিলি ও মাইকিং করেন। ২০১৭ সালের মার্চে গাজীপুরের কাপাসিয়া ও রাঙামাটি থেকে সম্ভাব্য গাছের খোঁজ মেলে। গবেষকেরা সংগৃহীত সব নমুনা পরীক্ষা করে কাপাসিয়ার গাছটির সঙ্গে আগে আঁকা ছবির সাদৃশ্য খুঁজে পান। তাঁরা উচ্চতর গবেষণার জন্য ফুটি কার্পাসের এই জাতটি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের মাঠে চাষ করেন। বর্তমানে গবেষণার প্রয়োজনে সেখানে ফুটি কার্পাসের প্রায় ৭০০ গাছের একটি সংগ্রহশালা গড়ে তোলা হয়েছে।

কাপাসিয়ার হাইলজোর গ্রামের বেলায়েত মাস্টারের বাড়িতে এই জাতের দুটি গাছ দেখেছি। আরও ২০ থেকে ২৫টি গাছ এই গ্রামে দেখা যায়। গাছটির উদ্ভিতাত্ত্বিক নাম Gossypium arboreum var. neglecta

ফুটি কার্পাস মূলত নরম কাণ্ডের গুল্মশ্রেণির বহুবর্ষজীবী উদ্ভিদ। পরিণত কাণ্ড ও ডালপালা নুয়ে পড়ে। সবুজ রঙের শিরাল পাতাগুলো করতলাকৃতির, গভীরভাবে তিন ভাগে বিভক্ত। সুদৃশ্য মঞ্জরিঢাকনাও অসমান। ফুলের বৃতি পেয়ালাকৃতির, দলমণ্ডল ফ্যাকাশে হলুদ বা সাদা, পাপড়িসংখ্যা ৫। এই গ্রামেই আমরা বাণিজ্যিক জাতের (Gossypium spp.) কার্পাসের বেশ কিছু প্রদর্শনী প্লট দেখতে পেলাম। সব মিলিয়ে এ বছর কাপাসিয়ায় ১২০ বিঘার মধ্যে এই কার্পাসের চাষ হয়েছে। এতে তুলা উন্নয়ন বোর্ডের সার্বিক সহযোগিতা রয়েছে। এর মধ্যে গোসিপিয়াম হিরসুটাম জাতটি বিপন্ন। কাপাসিয়ার কার্পাস চাষকে সামাজিক মাধ্যমে জনপ্রিয় করে তোলার চেষ্টা করছেন সমাজসেবক ও প্রবীণ রাজনীতিবিদ আলী হোসাইন চৌধুরী। তিনিও আমাদের সঙ্গে বিভিন্ন মাঠ পরিদর্শনে শামিল হলেন।

স্থানীয় লোকজন মনে করেন, কাপাসিয়া এলাকাতেই মসলিনবিষয়ক একটি উচ্চতর গবেষণা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা প্রয়োজন। এ ছাড়া ফুটি কার্পাসের চাষাবাদ বাড়ানোর পাশাপাশি গাছগুলো সংরক্ষণে আরও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করাও এখন সময়ের দাবি হয়ে উঠেছে।

  • মোকারম হোসেন, প্রকৃতি ও পরিবেশবিষয়ক লেখক