দূষণ ও দখলের পাশাপাশি কর্ণফুলী নদীর দুই তীরের গাছপালাও ব্যাপক হারে ধ্বংস হচ্ছে। নদীর উজানের দিকে পাহাড়ি অঞ্চলে বিভিন্ন প্রজাতির উদ্ভিদের বনের দেখা মিললেও ভাটি অঞ্চলে বন উজাড় হয়ে গেছে। নদীর মোহনা থেকে কাপ্তাই বাঁধ পর্যন্ত দুই পাড়ে মোট ৫২৮ প্রজাতির উদ্ভিদ প্রজাতি শনাক্ত করেছেন একদল গবেষক। কিন্তু তার বেশির ভাগই উজানে। এর মধ্যে বিপন্ন প্রজাতির ৮১টি শনাক্ত করা হয়েছে।
কর্ণফুলী নদীর প্রাণ-প্রকৃতি, উদ্ভিদবৈচিত্র্য ও দূষণের কারণ নির্ণয়ে পরিচালিত এক গবেষণায় এ চিত্র উঠে আসে। বেসরকারি মানবিক, সামাজিক উন্নয়ন ও গবেষণা সংস্থা ইফেক্টিভ ক্রিয়েশন অন হিউম্যান ওপেইনিয়নের (ইকো) উদ্যোগে পরিচালিত এ গবেষণাকাজে মূলত যুক্ত ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষক ও শিক্ষার্থী। আজ শনিবার দুপুরে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করা হয়।
গবেষণায় নেতৃত্ব দেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ওমর ফারুক রাসেল। তিনি আবার ইকোর সাধারণ সম্পাদক।
সংবাদ সম্মেলনে ইকোর সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য শাহেদ মুরাদ ও এস এম আবু ইউসুফ উপস্থিত ছিলেন।
ওমর ফারুক রাসেল বলেন, ৫২৮ প্রজাতির উদ্ভিদের মধ্যে ১১৩টি একই পরিবারভুক্ত। এর মধ্যে বড় বৃক্ষ ১৪৪ প্রজাতির, গুল্ম ৬৯ প্রজাতির, লতা ৫৮ প্রজাতির, বীরুৎ ২৪৪ প্রজাতির ও পরজীবী ১৩ প্রজাতির।
জরিপ গবেষণাটি এ বছরের জানুয়ারি থেকে শুরু করে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত চলে। গবেষণায় বলা হয়, নদীর মাঝখানে অবস্থিত বাকলিয়া চরে ১৫৫ প্রজাতির উদ্ভিদ শনাক্ত করা হয়েছে। অন্যদিকে নদীর সবচেয়ে দূষিত এলাকা হিসেবে পরিচিত বঙ্গোপসাগর মোহনা থেকে কালুরঘাটের পর পর্যন্ত পাওয়া গেছে মোট ১২০ প্রজাতির উদ্ভিদ।
এ গবেষণায় শনাক্ত করা গাছের মধ্যে সর্বমোট ৩৫৫টি ঔষধি উদ্ভিদ রয়েছে। এর মধ্যে যেমন, কালমেঘ, হিজল, বেগুনি হুরহুরিয়া, হাড়গোজা, ছাতিম, আকন্দ, তুফানিলতা, হাতিশুঁড়, সোনালু, স্বর্ণলতা পাওয়া গেছে। ভবিষ্যতে বিপন্ন হতে পারে এমন প্রজাতির সংখ্যা ৬৩। যেমন কুরুজ, শ্যামলতা, চীনালতা ইত্যাদি।
ওমর ফারুক বলেন, নদীর মোহনা থেকে কালুরঘাট অংশে গাছপালা নানাভাবে ধ্বংস করা হয়েছে। কলকারখানা, বসতি স্থাপন কিংবা গাছ চুরিসহ বিভিন্ন কারণে এদিকে গাছপালা কমে গেছে। তবে কালুরঘাটের পর থেকে কাপ্তাই বাঁধ পর্যন্ত দুই পাশে ঘন বনাঞ্চল রয়েছে। তাঁরা দুই পাড়ের ১০ মিটার পর্যন্ত এলাকায় জরিপ গবেষণাটি চালান।
পাশাপাশি নদীর বিভিন্ন স্থানের দূষণের জন্য পানির নমুনাও পরীক্ষা করা হয়। এ ছাড়া দূষণের কারণগুলোও চিহ্নিত করা হয়। জরিপে বলা হয়, নদীর দুই পাশে প্রায় ৫০ হাজার খোলা শৌচাগার রয়েছে। এ ছাড়া নগরের বর্জ্য, কারখানার তরল ও সলিড বর্জ্য, শুঁটকিপল্লির বিষ ও বর্জ্য, কীটনাশক, ৫৩টি শিল্পকারখানার বর্জ্য, ১৪টি নৌযান মেরামতের জায়গা, বাজার, নালা, খামার ইত্যাদি দূষণের প্রধানতম কারণ। এ ছাড়া প্লাস্টিক ও পলিথিন দূষণে বড় ভূমিকার রাখছে।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, কর্ণফুলী নদীতে মার্চেন্ট জাহাজ ৮৫টি, কোস্টার জাহাজ ৪০৫টি, মাছ ধরার ট্রলার ২৬৪টি, টাগ নৌকা ৯টিসহ সাম্পান, ছোট ছোট নৌকা, বিদেশি জাহাজ, ট্রলার চলাচল করে। এসব নৌযানের ময়লা, পোড়া তেল ইত্যাদি নদীতে সরাসরি ফেলে। এ ছাড়া অসংখ্য নৌযান বঙ্গোপসাগর মোহনা থেকে কালুরঘাট পর্যন্ত নোঙর করে রাখায় নদীর স্বাভাবিক নাব্যতা, ডলফিনসহ জলজ প্রাণীদের স্বাভাবিক বিচরণ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। শিকলবাহা এলাকাকে ডলফিনের আবাস হিসেবে চিহ্নিত করেছে গবেষকদের দল।
নদী দখল ও দূষণ বন্ধ না হলে ভবিষ্যতে ৮১টি প্রজাতির বিপন্ন উদ্ভিদ হারিয়ে যেতে পারে। এ ছাড়া বনাঞ্চল আরও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। নদীতে বিভিন্ন ক্ষতিকারক রাসায়নিক দ্রব্যের মিশ্রণের ফলে দৈনন্দিন কাজে নদীর ওপর নির্ভরশীল মানুষের মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়।
নদীতে পলিথিন ও অন্যান্য সামগ্রী নিক্ষেপ না করা, পয়োবর্জ্য বন্ধ করা, গৃহস্থালির বর্জ্য নিক্ষেপ বন্ধসহ নানা সুপারিশ করা হয় গবেষণায়।