বৃষ্টি আসতে এত দেরি হচ্ছে কেন

প্রচণ্ড গরমে অস্থির জনজীবন। একটু শীতল পরশ পেতে পুকুরে দুরন্তপনায় মেতে উঠেছে শিশু-কিশোরেরা। মহালক্ষ্মীপাড়া, ব্রাহ্মণপাড়া, কুমিল্লা, ১৮ এপ্রিল, ২০২৩
ছবি: এম সাদেক

কি গ্রাম কি শহরে, মানুষ যেন চাতক পাখির মতো তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে। প্রচণ্ড গরমে দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে জনজীবন। কবিগুরু ‘রুদ্র বৈশাখের’ যে চিত্র তুলে ধরেছিলেন, তেমনই ‘ধুলায় ধূসর রুক্ষ’ চেহারা নিয়ে বৈশাখ হাজির হয়েছে। আকাশের দিকে চাতকের দৃষ্টি তাই বৃষ্টির জন্য। কংক্রিটের জঙ্গল এই রাজধানীতে গরমের দাপট যেন আরও বেশি। তবে শুধু রাজধানীতে নয়, বৃষ্টির কামনা দেশজুড়েই।

৭ এপ্রিল থেকে দেশ বৃষ্টিহীন। এর আগে ২ এপ্রিল পর্যন্ত দেশের নানা জায়গায় বৃষ্টি হয়েছে। তার পরের পাঁচ দিন কিছু জায়গায় বিক্ষিপ্তভাবে বৃষ্টি হয়েছে। ৭ তারিখ থেকে কোথাও বৃষ্টি নেই। এর মধ্যে গতকাল সোমবার দেশের উত্তর-পূর্বের জনপদ সিলেটে বৃষ্টি ঝরেছে। তবে এর পরিমাণ ছিল সামান্য। আজও দেশের দুই বিভাগের দু-এক জায়গায় বৃষ্টির পূর্বাভাস দিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।

৭ এপ্রিল থেকে টানা ১০ দিন দেশ বৃষ্টিহীন। তবে এমন নজির যে আগে ছিল না, তা নয়। আবহাওয়াবিদেরা বলছেন, বৃষ্টি হওয়ার জন্য প্রকৃতির কিছু শর্ত পূরণ দরকার। তা হচ্ছে না বা তাতে বিলম্ব হচ্ছে। এ কারণেই বৃষ্টি আসতে এই দেরি হচ্ছে।

আবহাওয়াবিদদের মতে, বৃষ্টির জন্য যে মেঘের দরকার, সেই মেঘ সৃষ্টি হতে পারছে না। শীতের হাওয়া এবং এ সময়ের তপ্ত হাওয়া—দুই-ই ভারতের উত্তর প্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ ও বিহার হয়ে বাংলাদেশের দিকে আসে। এটি বাংলাদেশের চুয়াডাঙ্গা, যশোর অঞ্চল দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। এই প্রবাহের সঙ্গে তৈরি হওয়া মেঘও আসতে চাইছে। কিন্তু তা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক সমরেন্দ্র কর্মকার প্রথম আলোকে বলেন, উত্তর প্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ ও বিহার হয়ে আসা মেঘ হারিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ভূখণ্ডে ঊর্ধ্ব ও নিম্ন আকাশে উষ্ণমণ্ডলীয় উচ্চ চাপ বলয়ের আধিক্য আছে। বঙ্গোপসাগর থেকে তৈরি আর্দ্রতা এই চাপের কারণে উত্তর দিকে বা উত্তর-পূর্ব দিকে আর এগোতে পারছে না। তিনি বলেন, ‘গত কয়েক দিনে বাংলাদেশ, ভারতের বিহার ও মধ্যপ্রদেশের আকাশ পরিষ্কার, মেঘহীন।’

আবহাওয়াবিদদের মতে, বৃষ্টির দরকার বজ্রমেঘ। আর তার জন্য চাই বাতাসে প্রচুর জলীয় বাষ্পের উপস্থিতি। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ থেকে যে প্রচণ্ড গরম পড়েছে, এর একটি বৈশিষ্ট্য হলো সেখানে আর্দ্রতার পরিমাণ ছিল খুব কম। ফলে ঘাম কম হয়েছে বটে, কিন্তু আবহাওয়া ছিল মাত্রাতিরিক্ত শুষ্ক।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ মো. উমর ফারুক প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই জলীয় বাষ্প আসবে দক্ষিণের বঙ্গোপসাগর থেকে। অনেক দিন ধরেই দখিনা বাতাস অনুপস্থিত। জলীয় বাষ্পের উপস্থিতি এত কমে গিয়েছিল যে বাতাসে এর উপস্থিতি ২০ শতাংশের নিচে চলে গেছে।’

তবে বৃষ্টির জন্য দরকারি দখিনা বাতাস শুরু হয়েছে। গতকাল সোমবার থেকে একটু করে বাতাস বইছে। তবে এটুকু যথেষ্ট নয়। উমর ফারুক বলেন, এক-দুই দিনের হাওয়ায় বজ্রমেঘ সৃষ্টি হবে না। টানা কয়েক দিন থাকলে বাতাস জলীয় বাষ্পে পরিপূর্ণ হয়ে যাবে। দখিনা বাতাসের এখন প্রবহমান পশ্চিমা বাতাস বাধা পেয়ে সেখানে মেঘের সৃষ্টি হবে। তাতেই আসবে বৃষ্টি।

উত্তপ্ত বাতাসের সঙ্গে ঠান্ডা হাওয়ার একটি সংমিশ্রণ এখন কাঙ্ক্ষিত। এই সংমিশ্রণ কেমন করে হতে পারে, এর ব্যাখ্যা দিয়েছেন আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ মো. বজলুর রশীদ। তিনি বলেন, ঠান্ডা বাতাস থাকে ঊর্ধ্বাকাশে। এটি যদি নিচের দিকে নেমে আসে, তাহলে গরম ও আর্দ্রতাযুক্ত বাতাসের সঙ্গে মিশ্রণ ঘটবে। তৈরি হবে ঘূর্ণন। লাটিম যেমন ঘোরে, তেমনি করে তৈরি হবে ঘূর্ণন। আর্দ্রতামুক্ত বাতাস যখন ওপর দিকে উঠবে, তখন ওপরের ঠান্ডা বাতাসের সঙ্গে এর সংঘাত হবে। এতে মেঘ সৃষ্টি হয়ে বৃষ্টি হবে।

আবহাওয়া দপ্তরের তথ্যমতে, গতকাল সোমবার ঢাকার তাপমাত্রা কমেছে। গতকাল ঢাকার তাপমাত্রা ছিল ৩৮ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আগের দিন যা ছিল ৩৯ডিগ্রি সেলসিয়াস। এর কারণ বাতাসে দখিনা হাওয়ার উপস্থিতি। এতে মানুষের ঘাম ছুটবে। তবে বৃষ্টির সম্ভাবনাও বাড়বে, আবহাওয়াবিদেরা তা–ই মনে করেন।