ভারতে পাহাড়–বন ধ্বংসের প্রভাবে সংকটে হাওর

পাহাড়ি ঢল ও টানা বৃষ্টিতে কিশোরগঞ্জের হাওর এলাকায় পানিবন্দী হয়ে পড়েছে লাখো মানুষ। কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জের উরদীঘি এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

বাংলাদেশের উজানে ভারত, ভুটান ও নেপাল। কয়লা ও চুনাপাথর তুলে উজানে পাহাড় ধ্বংস করা হচ্ছে। পাহাড়ের গাছপালা কাটা হচ্ছে। এতে বৃষ্টি হলেই উজান থেকে মাটি-পাথর এসে দেশের হাওর অঞ্চল ভরাট হচ্ছে। ফলে হাওরের পানি ধারণক্ষমতা কমে যাচ্ছে। এর মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উজানে প্রচুর বৃষ্টিতে হাওরাঞ্চলে বড় বন্যার সৃষ্টি হচ্ছে।

এ ছাড়া অপরিকল্পিতভাবে হাওরে উন্নয়নকাজের কারণে প্রবাহে বাধা পাওয়ায় পানি দ্রুত বেরিয়ে যেতে পারে না। এতে বন্যা দীর্ঘস্থায়ী রূপ নিচ্ছে। এ সংকট সমাধানে হাওরে খনন করা এবং বাঁধ দিয়ে প্রবাহ বন্ধ করা থেকে বিরত থাকতে হবে।

‘হাওরে বন্যা ও সম্পদ ব্যবস্থাপনা’ শীর্ষক এক দিনব্যাপী সেমিনারের প্রথম অংশে এসব কথা বলেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। আজ বুধবার সকালে রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের মিলনায়তনে এ সেমিনারের আয়োজন করে আইইবির টাস্ক ফোর্স অন ওয়াটার সেক্টর।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক বলেন, ‘আমরা ভাটির দেশের লোক। আমাদের উজানে ভারত, ভুটান ও নেপাল। মেঘালয়–চেরাপুঞ্জিতে পাহাড় ও গাছপালা কেটে ফেলা হচ্ছে। এতে উজানের পাহাড়ের মাটি বৃষ্টির সময় বাংলাদেশে চলে আসছে।’

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রচুর পরিমাণে বৃষ্টি হচ্ছে উল্লেখ করে জাহিদ ফারুক বলেন, ‘কিন্তু সেই বৃষ্টি ধারণ করার ক্ষমতা আমাদের নেই। এ ধারণক্ষমতা বাড়াতে হবে। এ জন্য খননের কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু ঢলে মাটি–পাথর আসায় একবার খনন করলে সমস্যার সমাধান হবে না। প্রতিবছর খনন করতে হবে। কিন্তু এ খননকাজ যে কত ব্যয়বহুল, যারা করে তারা জানে। সরকার এ মুহূর্তে আর্থিক সংকটে রয়েছে।’ তারপরও ১৫টি নদী খননের একটি প্রকল্প প্রস্তুত করা হচ্ছে বলেও তিনি জানান।

অভিজ্ঞতা তুলে ধরে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের সন্তান ও কিশোরগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য রেজওয়ান আহাম্মদ তৌফিক বলেন, হিজল, করচ ইত্যাদি গাছে হাওর একসময় জঙ্গলের মতো ছিল। সেখানে হাঁটুর নিচে পানি থাকত। জঙ্গল কেটে লোকেরা চাষাবাদ করতেন। এখানে পানি হওয়া শুরু হয় ১৯১৮ সালের দিকে রেললাইন স্থাপনের পর থেকে। তার আগে হাওরের পানি বিভিন্ন দিক দিয়ে বেরিয়ে যেত। রেললাইন হওয়ার পর পানি কেবল ভৈরব দিয়ে বের হতে পারে। তখন থেকেই বন্যা হতে শুরু করল। পানিপ্রবাহ ঠিক রাখতে সুনামগঞ্জ থেকে ভৈরব পর্যন্ত নদী খনন করার প্রস্তাব দেন তিনি।

২০১৫ সালের আগেও সীমান্তে অনেক জঙ্গল ছিল এবং পানি আসতে অনেক সময় লাগত বলে জানান হাওর বাঁচাও আন্দোলনের সভাপতি আবু সুফিয়ান মুন্সি। তিনি বলেন, এখন বৃষ্টির পর দু-তিন ঘণ্টায় হাওরে পানি চলে আসে। পানি এলে আর নামে না।

খনিজ সম্পদ তুলে পাহাড় নষ্ট বন্ধ করতে বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেছেন উল্লেখ করে সুনামগঞ্জের তাহিরপুরের উপজেলা চেয়ারম্যান করুনা সিন্দ চৌধুরী বলেন, ‘বললেই কি আর পাহাড় সামলানো যায়। কারণ, পাহাড়ের নিচে কয়লা ও চুনাপাথর আছে। সেগুলো উঠিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এতে পরিবেশ আমাদের জন্য হুমকির হয়ে দাঁড়িয়েছে।’

হাওর এলাকার ইকো-সিস্টেম ফিরিয়ে আনার প্রতি গুরুত্ব দেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের মহাপরিচালক ফজলুর রশিদ। তিনি বলেন, প্রাণী ও উদ্ভিদ সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রতি চার-পাঁচ বছর পরপর একটি বড় বন্যা আসে। তারপরও ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনা যায়, সেভাবে ব্যবস্থাপনা করা প্রয়োজন।

হাওরে মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞার প্রস্তাব

হাওরে মাছ উৎপাদন খুবই কম। হাওরে হেক্টরে মাত্র ৪৪৪ কেজির মতো মাছ উৎপাদন হয় উল্লেখ করে মৎস্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক খ. মাহবুবুল হক বলেন, এর কারণ হচ্ছে দীর্ঘ সময় হাওরে পানি থাকে না। ফলে প্রজনন করার জন্য মাছ থাকে না। মৎস্য সংরক্ষণ আইনের আওতায় একটি সুনির্দিষ্ট জায়গা চিহ্নিত করে তার পার্শ্ববর্তী খাল, নদীকে অভয়াশ্রম ঘোষণা করে মাছ ধরা স্থায়ীভাবে বন্ধ করে দিতে হবে। এ জন্য চলতি বছর বাড়তি অর্থের সংস্থান রাখা হয়েছে বলেও জানান তিনি।

হাওর এলাকায় প্রজননের সময় দুই থেকে তিন মাস মাছ ধরা বন্ধ রাখার প্রস্তাব দেন দুই সংসদ সদস্যসহ অনেকেই।

আগাম ফসল তোলা যায়, ধানের এমন জাত উদ্ভাবনের প্রস্তাব

সম্প্রতি আগাম পানির ঢল বা বন্যার কারণে হাওরে ফসল নষ্ট হচ্ছে। ফলে আগাম ফসল তুলে আনা যায়, এমন ধানের জাত উদ্ভাবনের প্রস্তাব দেন বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ। এ ছাড়া হাওরের নিচু জায়গায় মাছের অভয়ারণ্য করা কিংবা দ্রুত ওঠে, এমন ফসল চাষ করার প্রস্তাবও সেমিনারে এসেছে।

স্বল্প জীবনকাল ও ঠান্ডা সহ্য করতে পারে, এমন ধানের জাত উদ্ভাবনের চেষ্টা চলছে বলে উল্লেখ করেন বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিআরআরআই) মহাপরিচালক মো. শাহজাহান কবীর। তিনি বলেন, পুরো জীবনকালে যেন ঠান্ডা সহ্য করতে পারে, এমন ধরনের ধানের জাত উদ্ভাবনের চেষ্টা চলছে।

শাহজাহান কবীর বলেন, হাওরে শুষ্ক মৌসুমে পানি থাকে না। পানির অভাবের কারণে হাওরে অনেক ধান চিটা হয়ে যায়। তিনি হাওরে পানির স্তর নিচে চলে যাওয়ার আশঙ্কা নেই উল্লেখ করে সেখানকার ভূগর্ভস্থ উৎস্য থেকে পানি ব্যবহারের পরামর্শ দেন।

আইইবির টাস্ক ফোর্স অন ওয়াটার সেক্টরের সভাপতি প্রকৌশলী মো. হাবিবুর রহমানের সভাপতিত্ব অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন টাস্ক ফোর্সের সদস্যসচিব প্রকৌশলী ইমু রিয়াজুল হাসান। এ সময় আরও বক্তব্য দেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. বেনজীর আলম, পরিচালক মো. হাবিবুর রহমান, পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী মো. আমিরুল হোসেন, বুয়েটের অধ্যাপক মোস্তফা আলী, একাত্তর টেলিভিশনের প্রধান নির্বাহী প্রকৌশলী মোজ্জামেল বাবু প্রমুখ।