রবীন্দ্রনাথের মল্লিকামঞ্জরী

শারদমল্লিকাছবি: লেখক

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর সমগ্র রচনায় অসংখ্যবার মল্লিকা ফুলের কথা বলেছেন। তাঁর কথা-কবিতা ও সংগীতে বহুল উল্লেখিত সেই মল্লিকা আসলে কোনটিÑতা নিয়ে উদ্ভিদ–গবেষকদের মধ্যে রয়েছে বিতর্ক। কারণ, আমাদের দেশে মল্লিকা নামে অনেক ফুল আছে। যেমন চন্দ্রমল্লিকা, কাঠমল্লিকা, গিরিমল্লিকা, বনমল্লিকা ও শারদমল্লিকা।

চন্দ্রমল্লিকা শীত মৌসুমের ফুল। অল্প সময়ের জন্য চাষ করা হয়। কাঠমল্লিকা হচ্ছে টগর; প্রায় সারা বছরই প্রস্ফুটন–প্রাচুর্যে প্রাণদীপ্ত থাকে। আর গিরিমল্লিকা মানে কুরচি; আমাদের বন–পাহাড়ে বসন্ত-গ্রীষ্মে ফোটে। শারদমল্লিকা ফোটে শরৎ-হেমন্তে; কিন্তু আমাদের দেশে দুষ্প্রাপ্য। শুধু বলধা গার্ডেনের সাইকিতে দেখেছি।

বনমল্লিকা। রাজধানীর বলধা গার্ডেনের সাইকিতে
ছবি: লেখক

তবে অধিকাংশ গবেষক বনমল্লিকা ফুলকেই রবীন্দ্রনাথের প্রকৃত মল্লিকা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। কলকাতার উদ্ভিদবিষয়ক লেখক ও গবেষক বিষ্ণুস্বরূপের মতেও মল্লিকা হিসেবে রবীন্দ্রনাথ মূলত বনমল্লিকার কথাই বলেছেন। উদ্ভিদবিজ্ঞানী অধ্যাপক দ্বিজেন শর্মা তাঁর ফুলগুলি যেন কথা গ্রন্থে এ তথ্যসূত্র উল্লেখ করেছেন।

রবীন্দ্রনাথ কবিতার পঙ্‌ক্তিতে অন্তত সাতবার এবং সংগীতে পাঁচবার মল্লিকার কথা বলেছেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য কয়েকটি পঙ্‌ক্তি থেকে উদ্ধৃত করা যাক। ‘মল্লিকা চামেলী বেলি/ কুসুম তুলহ বালিকা’;  ‘পথপাশে মল্লিকা দাঁড়াল আসি/ বাতাসে সুগন্ধের বাজাল বাঁশি।’; ‘আমার মল্লিকা বনে যখন প্রথম ধরেছে কলি।’; ‘বনপথ হতে, সুন্দরী,/ এনেছি মল্লিকামঞ্জরী।’ গানেও আছে নানাভাবে—‘বর্ষণমন্দ্রিত অন্ধকারে/ এনেছি মল্লিকামঞ্জরী’ অথবা ‘লিখন তোমার ধুলায় হয়েছে ধূলি/ মল্লিকা আজি কাননে কাননে কত’। আবার কোনো কোনো গানে তিনি মল্লিকামাল্য মানে মল্লিকার মালার কথা বলেছেন। তাহলে একটি বিষয় স্পষ্ট যে মল্লিকা এমন একটি ফুল যা দিয়ে মালা বানানোর প্রচলন রয়েছে।

আলোচ্য বনমল্লিকা Jasminum Laurifolium জুঁইজাতীয় একধরনের আরোহী গুল্ম। ফুল দেখতে চামেলি ফুলের মতো সাদা। তবে পাপড়ির সংখ্যা কম, ১২ থেকে ১৪। পাতা বা কাণ্ড দেখতে অনেকটা কুন্দ ফুলের মতো। মূলত বনজুঁই বা মল্লিকার একটি প্রজাতি। অভিজ্ঞতা ছাড়া শনাক্ত করা কঠিন। ১৯২৫ সালে চট্টগ্রাম জেলা থেকে এই ফুল সম্পর্কে রিপোর্ট করা হয়েছিল।

উদ্ভিদবিদ শামসুল হক জানিয়েছেন, শারদমল্লিকার দ্বিপদী নাম ছিল ‘জেসমিনাম অটামনালিস’। এই নামের দ্বিতীয় অংশ ‘অটামনালিস’-এর বাংলা অর্থ থেকেই মূলত শারদমল্লিকা নামকরণ। কারণ, ফুলটি সাধারণত শরৎ-হেমন্তে ফোটে। বাহন পেলে গাছটি উচ্চতায় ছয় মিটার পর্যন্ত বাড়তে পারে। প্রজাতিটির বিভিন্ন রকমফের দেখা যায়। ফুলের গড়নেও রয়েছে ভিন্নতা।

বিভিন্ন পঙ্‌ক্তিতে রবীন্দ্রনাথ মল্লিকার যে উদ্ধৃতিগুলো ব্যবহার করেছেন, তার উপলক্ষ এবং প্রায়োগিক ভঙ্গি নিবিড়ভাবে বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়,Ñচন্দ্রমল্লিকা, গিরিমল্লিকা বা কাঠমল্লিকা আমাদের কাঙ্ক্ষিত মল্লিকা না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। তবুও এখানে ফুলগুলোর সংক্ষিপ্ত পরিচিতি তুলে ধরা আবশ্যক। আমাদের দেশে টগরের কয়েকটি রকমফের দেখা যায়—বুনো টগর থাকে বনেবাদাড়ে, কখনো কখনো পথের ধারে বা বাগানে।

হাত দুয়েক উঁচু গাছে ফুল ফোটে বলে সহজেই আমাদের চোখে পড়ে। ফুলের রং বেশ ধবধবে সাদা। গাছটির উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, প্রায় সারা বছরই গাছে কমবেশি ফুল থাকে। পাঁচটি পাপড়ির সাদা রঙের ফুলে গাছ ভরে থাকে। খোলা পাপড়ির এই ফুল তিন থেকে পাঁচ সেন্টিমিটার চওড়া। ইদানীং নানান উৎসবে সাজসজ্জার প্রয়োজনেও এ ফুলের চাষ হয়। ফুলচাষিরা ফুলের কলিগুলো বাজারে বিক্রি করেন। তখন এ ফুলের নাম ‘গাজরা’।

চন্দ্রমল্লিকা শীত মৌসুমের ফুল। পৃথিবীজুড়ে এ ফুলের অজস্র রকমফের চোখে পড়ে। চন্দ্রমল্লিকার জন্ম চীনে। সমাদর জাপানে। জাপানিদের জাতীয় ফুল। গাছ ৩০ থেকে ৬০ সেন্টিমিটার উঁচু হতে পারে। এগুলো ঝোপালো ধরনের উদ্ভিদ। ফুল ৫ সেন্টিমিটার চওড়া, সাদা ও হলুদের নানান মিশেল। কখনো মাঝখানে বাদামি ও পাপড়ি হালকা হলুদ। কোনো কোনো প্রজাতির ফুল আরও বিচিত্র ও বর্ণাঢ্য রঙেরÑসাদা, হলুদ, লাল, গোলাপি, কমলা ও বেগুনির নানান মিশেল, পাপড়ির গোড়া ও মাঝখানের রং বেশ গাঢ়।

কুরচি বা গিরিমল্লিকা কোমল সাদা রং আর সুগন্ধের জন্য বিখ্যাত। মাঝারি আকারের বৃক্ষ। কাণ্ড গোলগাল, বাকল অসমান ও হালকা ধূসর রঙের। পাতা একটু লম্বা ও বড়। শীতকালে সব পাতা ঝরে পড়ে। ফাল্গুন মাসের শেষ দিকে দু-একটি কচি পাতার সঙ্গে ফুলগুলো ফুটতে শুরু করে। পাঁচটি পাপড়ির এই ফুল বেশ মধুগন্ধি। ফুলের নিচের অংশ নলাকৃতির, ওপরটা মুক্ত–পাপড়িতে ছড়ানো। মুক্ত অংশটি আবার কিছুটা বাঁকানো।

  • মোকারম হোসেন, প্রকৃতি ও পরিবেশবিষয়ক লেখক