এশীয় কালো ভালুকের খোঁজে
মৌলভীবাজারের এক গহিন বনে সারা দিন ধরে হাঁটছি। আকাশভরা মেঘ, সারা দিন ধরে থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে। পুরো শরীর রেইনকোটে মোড়ানো। ছড়াপথে উদবিড়ালসহ নানা প্রাণীর চিহ্ন খুঁজে চলেছি। সঙ্গে আছে দীর্ঘদিনের গবেষণা সহকারী, বন্ধু হারিস দেববর্মা।
ঝিরিপথের কাদাজলে জোঁক ছেয়ে আছে। কিছুক্ষণ পরপর জোঁক ছাড়াচ্ছি। পা থেকে রক্ত ঝরছে। মাথার ওপর দিয়ে মাঝেমধ্যেই উড়ে যাচ্ছে দারুণ সুন্দর উদয়ী বামন মাছরাঙা।
কিন্তু বুনো প্রাণী নিয়ে গবেষণায় অন্য কোনো দিকে তাকানোর সুয়োগ নেই। কাছের গ্রামে আলো থাকতেই পৌঁছাতে হবে। হঠাৎ সামনে বেশ উঁচু আর খাড়া এক পাহাড়। পুরো পাহাড়ে পুরোনো বাঁশঝাড়, মাঝেমধ্যে বড় গাছ। কষ্ট করে উঠছি।
প্রায় প্রতিটি গাছেই একেবারে গোড়া থেকে মাথা পর্যন্ত অনেক আঁচড়ের দাগ, প্রতিটিই লম্বা আর নির্দিষ্ট আকৃতির। কিছু আঁচড় বেশ নতুন, গাছ থেকে কষ পড়ছে। যেন একটু আগেই দাগগুলো পড়েছে। বনে সন্ধ্যার অন্ধকার দ্রুতই নামে। তবু শিহরণ–জাগানিয়া এই দাগগুলোর প্রয়োজনীয় মাপ নিলাম, ছবিও তুলে রাখলাম। কারণ, এ যে ভালুকের নখের দাগ।
ঢাকা ফিরেই ছবিগুলো আইইউসিএনের ভালুক গবেষক দলের বেশ কজন বন্ধুকে পাঠালাম। ডজনখানেক বিশেষ ধরনের ক্যামেরা নিয়ে দ্রুতই আবার সেই গহিন বনে হাজির হলাম। যেকোনো প্রাণী তার সামনে পড়লেই ছবি পাওয়া যায়। রাত–দিন, বর্ষায়—সব সময় অটোমেটিক ছবি তুলতে পারে। বুনো প্রাণীর উপস্থিতি নির্ণয়ে দারুণ এক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি।
দুই ধাপে প্রায় ২০ বর্গকিলোমিটার জায়গাজুড়ে ক্যামেরা বসালাম। ছয় মাস ক্যামেরা রাখব। সেই সঙ্গে ১৫ দিন অন্তর ক্যামেরার মেমোরি কার্ড চেক করে দেখতে হবে। অনেক প্রজাতির বুনো প্রাণীর ছবি পাচ্ছিলাম। আমার ধারণা, এ দেশের কারও কল্পনাতেও নেই যে এই বনটি এত জীবন্ত। তারপর সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। ভালুক। সিলেটের মিশ্র চিরসবুজ বনে প্রথমবারের মতো ক্যামেরায় ধরা পড়ল একটি নয়, পাঁচ পাঁচটি আলাদা এশীয় কালো ভালুক। বুকের দাগ থেকে প্রতিটি ভালুককে আলাদা করা যায়।
এশীয় কালো ভালুক মাংসভুক গোত্রভুক্ত হলেও মধু, ছোট ফল, পোকামাকড়ই বেশি খেয়ে থাকে। মানুষকে এড়িয়ে চলতেই পছন্দ করে। বন গহিন হলেও মানুষের আনাগোনা কিন্তু কম নয়। বাঁশ, মধু, ফল নিয়মিত আহরণ করা হয়।
খুব কষ্টের এক গল্প শুনলাম। ভালুক যেন না আসে, সে কারণে সব কাঁঠাল পাকার আগেই কেটে ফেলা হয়েছে। বন্দুকধারী শিকারিও নিয়মিত ক্যামেরায় এসেছে। আবার ভালুকের আক্রমণে বেঁচে যাওয়া এক মধু সংগ্রহকারীর সঙ্গেও দেখা হলো। এত কিছুর পরেও ভালুকের উপস্থিতি বাংলাদেশের জন্য সৌভাগ্য বটে।
উপমহাদেশের চার প্রজাতির ভালুকের মধ্যে তিনটিই কিন্তু একসময় বাংলাদেশে ছিল। লম্বা-ঝাঁকড়া লোমের শ্লথ ভালুক পাতাঝরা বনের উইপোকা-পিঁপড়া খেতেই পছন্দ করে। এ দেশে সমতলভূমির পাতাঝরা বন উজাড় হয়েছে সবচেয়ে বেশি। হারিয়েছে উইপোকার ঢিবিগুলো, সেই সঙ্গে শ্লথ ভালুকও নিয়েছে চিরবিদায়।
কালো ও সূর্য ভালুক বাংলাদেশে মহাবিপন্ন। এদের ভারতের উত্তর–পূর্ব দিকেই বেশি পাওয়া যায়। মধ্যভারত, শ্রীলঙ্কায় একেবারেই পাওয়া যায় না। সে হিসেবে বাংলাদেশের বনগুলোই পৃথিবীর অন্যতম বন ছিল, যেখানে তিনটি প্রজাতিই একসঙ্গে বাস করত।
তবে এ দেশে এখনো ভালুক আছে। গত পাঁচ বছরে অন্তত ২০টি পৃথক মানুষ-ভালুকের সংঘাতের খবর পড়েছি। ক্রিয়েটিভ কনজারভেশন অ্যালায়েন্স ও ড. সুপ্রিয় চাকমার ক্যামেরা ট্র্যাপ পদ্ধতির গবেষণায় পার্বত্য চট্টগ্রামে দুই প্রজাতিই পাওয়া গেছে। সম্প্রতি আইইউসিএন বাংলাদেশ এবং বন বিভাগের জরিপেও সূর্য ভালুকের ক্যামেরা-ট্র্যাপ ছবি কাসালং সংরক্ষিত বনে পাওয়া গেছে।
এ দেশে ভালুক অবহেলিত। ভালুকের ছবিগুলোর দিকে তাকিয়ে আছি আর ভাবছি, এরা কি ভুল, অপ্রতুল গবেষণা আর অবহেলায় একেবারেই হারিয়ে যাবে? দ্রুত ভালুক গণনা করে এ দেশে এর ভালো আবাসস্থলগুলো চিহ্নিত করা দরকার।
মুনতাসির আকাশ, সহকারী অধ্যাপক, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়