অনন্য বিচিত্র জারুল

বিচিত্র জারুল
রমনা পার্ক থেকে সম্প্রতি তোলা ছবি

ব্যবহারিক ক্ষেত্রে উদ্ভিদ উদ্যান যদি উদ্ভিদ-গবেষকদের বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো হয়, পার্ক সে ক্ষেত্রে অনেকটা পাঠশালার মতোই। সৌভাগ্য যে আমরা রমনা পার্কের মতো এমন একটি পাঠশালা পেয়েছি। যার সঙ্গে ঐতিহাসিকভাবে যুক্ত হয়েছিল ব্রিটিশ ভারতের কৃতী উদ্যান-স্থপতি আর এল প্রাউডলকের অন্যতম নিসর্গকর্ম ‘রমনা গ্রিন’।

বলে রাখা ভালো, রমনা পার্ক আর রমনা গ্রিন এক বিষয় নয়। রমনা গ্রিন বলতে যা বোঝায়, তার পরিধি অনেক দূর বিস্তৃত ছিল। ১০০ বছরের ব্যবধানে যার অধিকাংশই এখন নিশ্চিহ্ন।

তবু যেটুকু অবশিষ্ট আছে, তা আমাদের উদ্ভিদ ঐতিহ্যের উজ্জ্বল হীরকখণ্ডের মতো। বৃক্ষচর্চায় যার নান্দনিক ও বৈচিত্র্যপূর্ণ প্রভাব আমাদের নানাভাবে কৌতূহলী করেছে। ভাবনার জগৎকে করেছে ঋদ্ধ।

রমনা পার্কে ঘোরাঘুরির প্রথম দিকে অবচেতনে কিছু বৃক্ষ দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে। বিচিত্র জারুল তার মধ্যে একটি। কয়েক বছরের ব্যবধানে উপলব্ধি করি, গাছটি অনেক ক্ষেত্রেই ব্যতিক্রম। শরতে স্বল্প ফুলের দীনতায় দীর্ঘকালীন প্রস্ফুটন প্রাচুর্য এ গাছের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। লক্ষ করি, এমন একটি বিশেষায়িত বৃক্ষ রমনা পার্কের বাইরে খুব একটা নেই বললেই চলে। আবার জারুল গোত্রীয় হওয়ায় আমাদের নিজস্ব জারুল থেকে আলাদা করার জন্য ‘বিলাতি’ অভিধায় নামকরণ করা হয়েছে। একই পদ্ধতিতে আলাদা করে চেনানোর জন্য বিলাতি গাব, বিলাতি ধনেপাতা ইত্যাদি ক্ষেত্রেও ‘বিলাতি’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। আদতে উল্লিখিত তিনটি গাছের সঙ্গেই বিলাতের কোনো সম্পর্ক নেই! এ কারণেই ফুলের প্রকৃত বৈশিষ্ট্য বিবেচনায় নাম বিচিত্র জারুল হওয়াই সমীচীন।

বর্ষায় আমাদের প্রকৃতিতে বড় গাছে পুষ্পবৈচিত্র্য অনেকটাই কম। আষাঢ়ের প্রথম ভাগে চালতা আর কদম ফুল জৌলুশ হারায়। তত দিনে জারুল, সোনালু, কৃষ্ণচূড়াও রিক্ত-নিঃস্ব, হতশ্রী। কিন্তু বর্ষার এ বিবর্ণতাকে অতিক্রম করে শরতের ধোয়ামোছা সবুজ প্রকৃতি আমাদের নানাভাবে আচ্ছন্ন করে রাখে।

আবার বর্ষার জলাভূমির রাজসিক সৌন্দর্য পূর্ণতা পায় শরতে। তখন খাল-বিল-পুকুর-ডোবায় শান্ত জলে বিচিত্র জলজ ফুল রঙের পসরা সাজায়। কিন্তু নগর উদ্যানে এমন শোভা অনেকটাই অধরা। তবে কয়েক দশক ধরে সীমিত পরিসরে বর্ষা-শরতের বর্ণাঢ্যতা কিছুটা হলেও ফিরিয়ে এনেছে বিচিত্র জারুল।

বিচিত্র জারুল মূলত চীনের উদ্ভিদ প্রজাতি। আমাদের দেশে অভিষেক অনেক আগে। সে তুলনায় ততটা সহজলভ্য নয়। মূলত আলংকারিক বৃক্ষ হিসেবেই রোপণ করা হয়। রমনা পার্কের মাঝামাঝি স্থানে এ গাছের একটি সুদৃশ্য বীথি আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হল প্রাঙ্গণের মাঝারি উচ্চতার গাছটি প্রতিবছর পুষ্পশোভা ছড়িয়ে রাখে। মিরপুরে অবস্থিত জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানসহ সারা দেশে বিক্ষিপ্তভাবে দু–একটি গাছ চোখে পড়ে। ফুলের নজরকাড়া বেগুনি রং এবং দীর্ঘস্থায়িত্বের জন্য সর্বত্রই সমাদৃত।

বিচিত্র জারুল (Lagerstroemia thorelii) মাঝারি উচ্চতার বৃক্ষ। স্থানীয়ভাবে কোথাও কোথাও বারশা নামেও পরিচিত। এ গাছের খাটো দেহকাণ্ড এবং আগার দিকটা ঝোপাল। বাকল ফ্যাকাশে হলুদাভ-ধূসর। পত্র বিপ্রতীপ, উপবৃত্তাকার, প্রায় ১০ সেন্টিমিটার, মসৃণ এবং পত্রবৃন্ত প্রায় ৫ মিলিমিটার লম্বা। মঞ্জরি পর্যায়ক্রমিক পুষ্পশোভিত। ফুল আড়াআড়িভাবে প্রায় ৩ সেন্টিমিটার।

বৃতি নল ঘণ্টাকার, তারকাকারে কোমল লোমযুক্ত, ১২-শিরাল, বৃত্যংশ ৫টি, খাটো ও বাঁকা। পাপড়ি ৬টি, বর্তুলাকার, সরু হয়ে খাটো দলদণ্ডে পরিণত। ফুল প্রথমে নীলাভ-বেগুনি বা রক্তিমাভ।

কিন্তু অতি দ্রুত ফ্যাকাশে থেকে সাদায় রূপান্তরিত হয়। পুংকেশর অসংখ্য, বৃতি নলের পাদদেশের কাছে সন্নিবেশিত, পরাগধানি সর্বমুখ। ফল ক্যাপসিউল মতো, ডিম্বাকার, প্রায় দেড় সেন্টিমিটার লম্বা, বিদারী, স্থায়ী বৃতি দ্বারা আবৃত। এ গাছ বাংলাদেশ ছাড়া ভারত ও লাওসেও পাওয়া যায়। এরা ছায়াবৃক্ষ হিসেবেও উত্তম। ফুল ফোটার মৌসুম শ্রাবণের শেষ ভাগ থেকে শরৎ-হেমন্ত অবধি বিস্তৃত।

মোকারম হোসেন, প্রকৃতি পরিবেশবিষয়ক লেখক