সুন্দরবনের রানির দেখা
ভোরের কুয়াশা ভেদ করে খুব সকালেই রওনা হয়েছি আমরা। ভদ্রা বনফাঁড়ি থেকে আমাদের গন্তব্য দক্ষিণে—বেশ দূরে, বনের অনেক গভীরে। শীতকাল বলে পানিতে ঢেউ নেই, পশুর নদ বেশ শান্ত।
ভদ্রা নদীতে নোঙর করা বন বিভাগের বনবালা নামের বোট থেকে সাম্পান নৌকায় এগিয়ে চলেছি পশুর নদ ধরে। বন বিভাগের সুন্দরবন সুরক্ষা প্রকল্পের আওতায় সুন্দরবনের ইকোলজিক্যাল মনিটরিংয়ের তথ্য সংগ্রহের কাজে এসেছি। জানুয়ারির ২১ তারিখ সকালে মোংলা ফরেস্ট ঘাট থেকে আমরা রওনা হয়েছি। ভদ্রা বন্য প্রাণী (ডলফিন) অভয়ারণ্য অতিক্রম করার সময় বেশ কিছু নদীর শুশুক ও ইরাবতী ডলফিন দেখে সকালটা আনন্দময় হয়ে উঠল। মাছের ঝাঁকের পেছনে ছুটে ছুটে শিকারে মেতে উঠেছে ডলফিনগুলো।
ঘণ্টাখানেক চলার পর আমাদের সাম্পান যখন চাউলাবগিতে প্রবেশ করে, তখন পুবের বন ভেদ করে সূর্য উঁকি দিচ্ছে। ইতিমধ্যে কুয়াশা কিছুটা কেটে গেছে। দুই পাশে কুয়াশায় মোড়ানো বন ধীরে ধীরে জেগে উঠছে। দূরে দু–একটি জেলেনৌকা দেখা যাচ্ছে। আঁকাবাঁকা অপ্রশস্ত নদী ধরে প্রায় ১৫ কিলোমিটার অতিক্রম করে আমরা একটা সরু খালে ঢুকি। জোয়ার শুরু হয়েছে তা–ও ঘণ্টাখানেক আগে। নানা নির্দেশক বন্য প্রাণীর ওপর তথ্য সংগ্রহ করছি আমরা। দু–একটি হরিণ, ভোঁদড় ও বাদামি পাখনার মাছরাঙা দেখতে পেলাম কয়েকটি খালে।
খালের মাথা থেকে ফেরার পথে ভাটায় শুকিয়ে যাওয়া একটি ছোট্ট খালের তলা থেকে একটি পাখিকে দ্রুত ওপরে উঠে যেতে দেখলাম। বেশ দূরে হওয়ায় পরিষ্কার বোঝা গেল না; তবে পায়ের পাতা হালকা সবুজ রঙের মনে হলো। সন্দেহ সৃষ্টি হলো মনে। আমার দীর্ঘদিনের গবেষণা সহকারী পিন্টু বৈদ্য আমার সঙ্গে একমত হলো যে এটি বাদাবনের হাঁস হবে। হাঁসটি ভালো করে দেখার আশায় প্রায় দুই শ মিটার দূরে খালের উল্টো পাশে আমরা সাম্পান বন্ধ করে বসে রইলাম।
দুপুরের সূর্য ইতিমধ্যে দক্ষিণ দিক দিয়ে পশ্চিমে যেতে শুরু করেছে। জোয়ার আসতে এখনো বেশ দেরি, ফলে এটি নিশ্চয় আবারও খাবার খেতে নেমে আসবে। প্রায় ২০ মিনিট পর সত্যি সত্যি লতা সুন্দরীর ঝোপ থেকে ধীরে ধীরে বেরিয়ে এল সুন্দরবনের রানি—বাদাবনের হাঁস। মাথা উঁচু করে রাজকীয় ভঙ্গিমায় গা ভাসিয়ে দিয়েছে পাশের একটি খালের দিকে। কয়েক মিনিট সময় পেলাম আমরা। খালের গা ঘেঁষে জোয়ারের স্রোতের সঙ্গে ঢুকে গেল বনের গভীরে। এই হাঁসের কেতাবি নাম মাস্কড ফিনফুট। স্থানীয় লোকজন বলেন গোলবনের হাঁস।
এক অনাবিল আনন্দ নিয়ে বেরিয়ে এলাম খাল থেকে। প্রায় আধা ঘণ্টা সাম্পান চালিয়ে আমরা আমাদের দ্বিতীয় সার্ভে খালে প্রবেশ করি। এরই মধ্যে জোয়ার অর্ধেক হয়ে গেছে। তাই দ্রুত আমাদের পর্যবেক্ষণ শেষ করতে হবে। কিছু দূর যাওয়ার পর আমাদের চমকে দিয়ে খালের নিচের দিকে একটি গোলগাছের গোড়া থেকে আরেকটি বাদাবনের হাঁস পানি ঝাপটে আমাদের বিপরীত দিকে উড়তে শুরু করল। ওই মুহূর্ত আমার কাছে স্বপ্নের মতো হচ্ছিল। সুন্দরবনে বছরের পর বছর অসংখ্য খালবিল চষে বেড়ালেও যেখানে একটি হাঁসের দেখা পাওয়া বিরল ঘটনা, সেখানে মাত্র এক ঘণ্টার ব্যবধানে তিন কিলোমিটার দূরে আরেকটি হাঁসের দেখা পাব—এটি ভাবনায়ই আসেনি। হাঁসটি একটু উড়ে গিয়ে আবার আরেকটি গোলগাছের আড়ালে গিয়ে বসল। পরক্ষণেই আবার উড়ে গেল বেশ কিছু দূর, এরপর ঢুকে পড়ল পাশের গেওয়া-সুন্দরীর গভীর বনে।
রাতের খাবারের পর বোটে বসে আমার সহকর্মী অধ্যাপক মনিরুল খান কিছুটা হতাশার সুরে বলছিলেন, আমাদের জীবদ্দশায় বাংলাদেশ থেকে বেশ কিছু বুনো প্রাণীর বিলুপ্তি ঘটতে পারে, তার মধ্যে হয়তো সুন্দরবনের বাদাবনের হাঁস একটি। এমন রাজকীয়, বীরের মতো বুক উঁচিয়ে চলা বাদাবনের এই হাঁস সারা দুনিয়ার মাত্র কয়েকটি দেশে আছে। সংখ্যা হাতে গোনা যায়। সারা দুনিয়ায় বাংলাদেশের সুন্দরবন এই হাঁসের শেষ আশ্রয়স্থল। আইইউসিএনের ২০২০ সালের লাল তালিকা অনুযায়ী এটি মহাবিপন্ন। বাংলাদেশেও তা–ই। গোটা দুনিয়ায় এর সংখ্যা মাত্র সর্বনিম্ন ১০৮ থেকে সর্বোচ্চ ৩০৪টি। এর মধ্যে অর্ধেক আছে আমাদের সুন্দরবনে, বাকি অর্ধেক আছে কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, লাওস ও মিয়ানমারে। ভারতের সুন্দরবন অংশ থেকেও এটির বিলুপ্তি ঘটেছে। এর সংখ্যা কমছে অতি দ্রুত হারে। বিগত দশকে এই সংখ্যা কমে কোথায় দাঁড়িয়েছে, আমরা জানি না।
ড. এম এ আজিজ: অধ্যাপক, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়