অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসী পক্ষী আলোকচিত্রী শিহাব উদ্দিনের কাছে ২৭–২৮ বছর আগে লাল ডানার ঝুঁটিয়াল পাখির একটি ছবি দেখেছিলাম। পরে বিশিষ্ট পক্ষীবিদ শরীফ খানের সঙ্গে বেশ কয়েকবার এ পাখির সন্ধান করেছি। দেখা পাইনি। এরপর বহু বছর গড়িয়ে গেছে। কিন্তু ভাগ্য অপ্রসন্ন।
বর্ষায় সুন্দরবনের রূপ দেখতে ২০১৯ সালের ১৮ জুলাই ‘আভিযাত্রিক সুন্দরবন’-এর ব্যানারে ১০ জনের একটা দল ছুটলাম। পরদিন সকালে লঞ্চের সঙ্গে থাকা কোষানৌকায় জামতলী খালে ঢুকেছি।
আধা ঘণ্টার মতো খালে ঘুরে কিছু পাখির ছবি তুলে যখন খয়েরি-মাথা সুইচোরার ছানার ছবি তুলছি, ঠিক তখনই লাল ডানার পাখিটিকে চোখের সামনে দিয়ে উড়ে যেতে দেখলাম। পাখিটি উড়ে গিয়ে খালপাড়ের কেওড়াগাছে বসল। দ্রুত ক্যামেরার ভিউ ফাইন্ডারে চোখ রেখে ক্লিক করলাম। কিন্তু পাখিটি দ্রুত উড়াল দিল। একজন ছাড়া বাকি সবাই ছবি তুলতে ব্যর্থ হলাম।
দুপুরে দ্বিতীয়বারের মতো গেলাম জামতলী। সমুদ্রসৈকত থেকে ফেরার পথে আরও দুবার পাখিটিকে কয়েক সেকেন্ডের জন্য দেখলাম। কিন্তু দুবারই গাছের ঘন পাতার আড়ালে হারিয়ে গেল। বাঘের ভয়ে বেশিক্ষণ থাকা গেল না। ছবিও তোলা হলো না।
চলে গেল আরও প্রায় চারটি বছর।
বিরল একটি পাখির ছবি তুলতে ২০ মে গিয়েছি মিরপুরের জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানে। গিয়ে শুনলাম লাল ডানার ঝুঁটিয়াল পাখিটিকে দুই দিন ধরে অনেকেই দেখেছে। বেলা ১১টায় আমরা ২৩ নম্বর গেটসংলগ্ন লেকের পাশে পাখির ছবি তুলছি। এক সুহৃদ ফোনে জানাল, তারা পাখিটিকে দেখেছে।
প্রায় এক কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে দ্রুত সেখানে পৌঁছালাম। পাখিটি ততক্ষণে ঝোপের আড়ালে চলে গেছে। দুরন্ত এই পাখি গাছের আড়ালে-আবডালে থেকে প্রজাপতি ও মথের শুঁয়াপোকা ধরে খায়। বেলা ১১টা ৩৫ মিনিটে একযোগে ৭–৮ জনের ক্যামেরার শাটার গর্জে উঠতেই একটি গাছের পাতার আড়ালে পাখিটিকে লাফালাফি করতে দেখলাম। অনেক চেষ্টা করেও অস্থির পাখিটির পরিষ্কার ছবি তোলা গেল না। মিনিট বিশেক চেষ্টার পর অবশেষে অধরা পাখিটি ফ্রেমবন্দী হলো।
এত বছর খোঁজাখুঁজি ও চেষ্টার পর যে পাখির ছবি তুললাম, সেটি এ দেশের দুর্লভ প্রজনন পরিযায়ী পাখি লাল ডানা বা লাল পাখা কোকিল। পশ্চিমবঙ্গে বলে গোলা কোকিল। ইংরেজি নাম চেস্টনাট-উইংগড কাক্কু বা রেড-উইংগড ক্রেস্টেড কাক্কু। কুক্কুলিডি গোত্রের পাখিটির বৈজ্ঞানিক নাম Clamator coromandus। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ওরা বিস্তৃত।
লাল ডানা কোকিল চাতকের মতোই লম্বালেজি ঝুঁটিদার কোকিল। দেখে মনে হবে যেন লালচে চাতক। দেহের দৈর্ঘ্য ৩৮ থেকে ৪৬ গ্রাম ও ওজন ৬৬ থেকে ৮৬ গ্রাম। কালো মাথায় কালো ঝুঁটি, চোখ ও চঞ্চু কালো। পিঠের ওপরটা আর লম্বা লেজ চকচকে নীলচে কালো। ডানার ওপরটা আর প্রান্ত লাল। গাল ও গলা হালকা লালচে। ঘাড়ের ওপর অর্ধসাদা বন্ধনি। বুক-পেট সাদা। চোখের মণি গাঢ় বাদামি। পা ও পায়ের পাতা ধূসর। অপ্রাপ্তবয়স্ক পাখি ফ্যাকাশে, দেহের ওপরটা লালচে ফুটকিওয়ালা। ঝুঁটি ছোট।
গ্রীষ্মকালে দেশের সব ধরনের বনাঞ্চল ও বনের আশপাশের বৃক্ষবহুল অঞ্চলে পাখিটি দেখা যায়। সচরাচর একাকী বা জোড়ায় থাকে। ঘন ঝোপ বা পাতাঘেরা গাছে লুকিয়ে থাকে বলে সহজে নজরে আসে না। প্রধানত শুঁয়াপোকা ও নরম দেহের কীটপতঙ্গ খায়।
দ্রুত ডানা ঝাপটে গাছ থেকে গাছে ঘুরে বেড়ায়। সচরাচর নীরব। পুরুষ কোকিল অন্য সময় নীরব থাকলেও প্রজনন ঋতুতে উচ্চকণ্ঠে ব্রিপ-ব্রিপ-ব্রিপ শব্দে ডাকে।
মার্চ থেকে আগস্ট ওদের প্রজননকাল। বাসা না বানানো অন্যান্য কোকিলের মতো ওরাও না বানায় বাসা, না দেয় ডিমে তা, না করে ছানার যত্ন। সচরাচর ছাতারের বাসায় ওদের ডিমের সঙ্গে মিলিয়ে ২-৩টা নীল ডিম পেড়ে রাখে। ছাতারের ডিম ফোটার আগেই ওদের ডিম ফোটে। আয়ুষ্কাল চার বছরের বেশি।
আ ন ম আমিনুর রহমান, পাখি ও বন্য প্রাণী প্রজনন ও চিকিত্সা বিশেষজ্ঞ