পানিবন্দী এক মেছো বাঘ

কক্সবাজারের ডুলাহাজারা সাফারি পার্কে একটি মেছো বাঘ
ছবি: আ ন ম আমিনুর রহমান

বন্যার পানিতে ডুবে গেছে চরাচর। ঘরবাড়ি ধসে ও ভেসে কোথায় যে গেছে তীব্র রাতের পাহাড়ি ঢলে! আশ্রয়শিবিরে বানভাসি অসহায় মানুষের গাদাগাদি অবস্থান। ত্রাণের ওপরই বেঁচেবর্তে থাকছে তারা। ভারতের মেঘালয়-আসামের ঢলের পানি শাঁই শাঁই শব্দে নেমে আসছে।

বিধ্বস্ত ঘরবাড়ির পাশাপাশি কিছু বাড়ি টিকে আছে। একটি বিধ্বস্ত বাড়ির পাশে নৌকা ভিড়িয়ে একসঙ্গে দু–তিনজন তরুণ হাঁক ছাড়লেন, বাড়িতে কেউ আছেন? বাড়িতে যিনি ছিলেন, তিনি বসে ছিলেন ফুট তিনেক উঁচুতে, মোটা একটা গাছের ডালে। লাফ দিয়ে নামলেন তিনি ভাসমান ঘরের টিনের চালার ওপর, মুখ বেজার করে আর চোখ পাকিয়ে তাকালেন তিনি নৌকার মানুষের দিকে।

ভয়ে সবার পিলে চমকে গেল। উনি ওনার লেজটা অল্প অল্প দোলাচ্ছেন, কান দুটো সেঁটে আছে মাথার পাশে, দাঁত খিঁচিয়ে ভয় দেখাচ্ছেন নাকি উনি নিজেই ভয় পেয়েছেন, তা বোঝা গেল কয়েক সেকেন্ডের ভেতর। নৌকা সরে এসেছে বেশ কিছুটা দূরে, উনিও দিয়েছেন ডাইভ অন্য পাশের পানিতে, প্রবল স্রোতের ধাক্কা সামলাতে সামলাতে দূরের গন্তব্যে পাড়ি ধরলেন।

এই উনিটা হলেন একটি মেছো বাঘ। গোবাঘা, পাতিভাম, মেছো বিড়াল, বাঘডাশ নামেও পরিচিত। মাত্র ৬০ বছর আগেও গ্রামবাংলার বাগান, ঝোপঝাড়, হাওর-বাঁওড়পারের জঙ্গলে ভালো অবস্থায় টিকে থাকা এক তুখোড় শিকারি, অসমসাহসী মেছো বাঘের ইংরেজি নাম ফিশিং ক্যাট। বৈজ্ঞানিক নাম Prionailurus viverrinus. মূল শরীরের দৈর্ঘ্য ৮৬ সেন্টিমিটার, শুধু লেজটি ৩৩ সেন্টিমিটার। উচ্চতা ৪০-৪৭ সেন্টিমিটার। গাঁট্টাগোট্টা মেছো বাঘের ওজন ৭-১৫ কেজি।

মূল খাবার মাছ হলেও বন্যার পানি থেকে মাছ শিকার দুরূহ কাজ। আমাদের দেশে প্রতিবছরই বন্যা হয়, ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের সময়ও মেছো বাঘ, বিশেষ করে গ্রামবাংলা ও সুন্দরবনে খরগোশ, বেজি, খাটাশ ইত্যাদি প্রাণী পানিবন্দী হয়ে মহাবিপদে পড়ে। পানিবন্দী অবস্থায় অনাহারী প্রাণীগুলো দুর্বল হয়ে পড়ে। মানুষের নজরে পড়লে নির্মম মৃত্যুর শিকার হয়। অথচ জীববৈচিত্র্য রক্ষার জন্য আমরা কত–না আন্দোলন করি! বন্যার সময় ত্রাণসামগ্রী দিয়ে কত–না মানবিক সেবা করি! মানুষের চিকিৎসার ব্যবস্থা করি।

কিন্তু কখনো পানিবন্দী, অনাহারী ও অসহায় বন্য প্রাণীগুলোর জন্য আমরা কিছুই করি না, করিনি ও করার কোনো সম্ভাবনাও দেখি না। আমাদের গণমাধ্যমগুলোতেও পানিবন্দী অসহায় বন্য প্রাণীগুলোর ছবি বা খবর দেখিনি বললেই চলে। বাস্তবে আমি এমন সব প্রাণী দেখেছি। আগে উল্লেখিত মেছো বাঘটির ছবি হয়তো তুলতে পারতেন নৌকার সাতজন সাহসী তরুণ। ভয়ে তা পারেননি। ওই সাত তরুণ শুকনা প্যাকেটজাত খাবার নিয়ে পানিবন্দী মানুষকে ত্রাণ দিতে সিলেটের বন্যাকবলিত একটি এলাকায় গিয়েছিলেন। ওই তরুণদের সঙ্গে কথা হয় আমার।

তাঁদের একজন বলেন, ‘আঙ্কেল, আগে জানলে আমরা আস্ত মরা হাঁস বা মুরগি নিয়ে যেতাম, দূর থেকে ছুড়ে মারতাম। তাহলে হয়তো খেত।’ সাত তরুণকেই আমি আশ্বস্ত করলাম, মেছো বাঘ তুখোড় সাঁতারু। এটা তীব্র স্রোত কাটিয়ে সাঁতরাতে ওস্তাদ, ওটা কোথাও না কোথাও গিয়ে উঠেছে। ঘটনাটি গেল জুন মাসের মধ্যভাগের।

আমার প্রবল আশা, এ দেশে ‘বন্য প্রাণী ত্রাণ তহবিল’ গঠিত হবে। বন্যা বা যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় বিপদগ্রস্ত বন্য প্রাণীর জন্যও ত্রাণ টিম থাকবে, থাকবে খাদ্য বিতরণ কর্মসূচি। বন্যায় পানিবন্দী বন্য প্রাণীর দুর্দশা আমি দেখেছি। মেছো বাঘ বাংলাদেশে এখন বিপন্ন ও দুর্লভ।

আমি সর্বশেষ আমার গ্রামে অজান্তে একটি বাঘিনীর মুখোমুখি হয়ে পড়েছিলাম, যেটার দুধ পান করছিল তিনটি চোখ না ফোটা ছানা। সেই অভিজ্ঞতার বিস্তারিত বিবরণসহ আমার লেখা ‘মেছো বাঘের মুখোমুখি’ ছাপা হয়েছিল প্রথম আলোর ‘বিজ্ঞান প্রজন্ম’ পাতায় ২০০৭ সালের ১০ জুন।

শরীফ খান, পাখি ও বন্য প্রাণিবিষয়ক লেখক