১৪ নভেম্বর ব্লু-জোনে প্রবেশমুখে বিক্ষোভের সময় তাঁদের সঙ্গে কথা বলেন বেলেম সম্মেলনের সভাপতি আন্দ্রে কোরেয়া দ্য লাগো। আদিবাসীরা প্রশ্ন তুলেছেন, আলোচনার টেবিলে যদি তাঁদের জায়গা না হয়, তবে কেন তাঁদের বন থেকে এত দূর আসতে হলো?
দুবাই জলবায়ু সম্মেলনের ঘোষণা অনুযায়ী ব্রাজিলসহ কয়েকটি দেশ চায় জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে ধীরে ধীরে সরে আসতে। ২০৩৫ সালের ভেতর সবুজ জ্বালানির ব্যবহার চার গুণ বাড়াতে রাষ্ট্রগুলোকে চাপে রেখেছে বেলেম। কিন্তু সম্মেলনের এক সপ্তাহ পার হলেও বিশ্বনেতারা নির্দয়ভাবে নীরব।
ব্লু এবং গ্রিন জোনের পাশাপাশি বেলেম শহরজুড়ে জলবায়ু সম্মেলন উপলক্ষে নানা নাগরিক তৎপরতা চলছে। ১২-১৬ নভেম্বর অনুষ্ঠিত হলো পিপলস সামিট; ১৪-১৫ নভেম্বর হয়েছে পিপলস ট্রাইব্যুনাল—এখানে পরিবেশ গণহত্যার বিরুদ্ধে অপরাধগুলো প্রমাণসমেত নথিভুক্ত হয়েছে। ‘কপ দ্যু পবুতে’ তরুণ জলবায়ুকর্মী এবং অ্যাকটিভিস্টরা সমবেত হয়েছেন। ব্লু জোন থেকে বেশ দূরে এলডেইয়াতে আদিবাসীদের থাকার জন্য অস্থায়ী আবাস ‘কপ ভিলেজ’ বানানো হয়েছে। বিশেষ করে আমাজন অঞ্চলের আদিবাসীরা এখানে থাকছেন এবং নানা কর্মসূচির মাধ্যমে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন। ১৫ নভেম্বর বিকেলে তরুণ জলবায়ুকর্মীরা আদিবাসীদের সপক্ষেÿবন ও বসতি সুরক্ষায় বৈশ্বিক সংহতি তৈরি করেন।
রাত থেকে পানি ছিল না বাসায়। আমাদের বলা হয়েছে, বেলেমের লাইনের পানি নিরাপদ নয়। কেনা জারের পানি খাচ্ছি সবাই। বুরকিনা ফাসো, কেনিয়া, উগান্ডা, ইথিওপিয়া, শ্রীলঙ্কা, ফিলিপাইন, তানজানিয়া, আলজেরিয়া, পেরু, ভেনেজুয়েলা, আইভরিকোস্ট, বতসোয়ানার বন্ধুরা রাতে খাবারঘরে আড্ডা দিচ্ছিলাম। সব দেশেই পানিসংকটের গল্প। মাটির তলার পানি পাওয়া যাচ্ছে না। খুন হচ্ছে নদী-জলা-ঝিরি।
১৫ নভেম্বর ভোরে বাসায় পানি এসেছে। আজ সবার খুব তাড়া। সবাই ‘জলবায়ু পদযাত্রায়’ যোগ দেবে। মোবাইলে চার্জ দিয়ে রাখা, পাতলা কাপড় পরা, পানির বোতল, সানস্ক্রিন, ছাতা সঙ্গে রাখার পরামর্শ দিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বার্তা দিচ্ছেন জলবায়ুকর্মীরা। ১৫ নভেম্বর দীর্ঘ জলবায়ু-পদযাত্রায় (পিপলস সামিট ক্লাইমেট মার্চ) পৃথিবীকে বিক্রি না করার জোর দাবি উঠেছে। নতুন কার্বন-বাণিজ্য না চাপিয়ে জনগণের জলবায়ু সমাধান মেনে নিয়ে বিশ্বনেতাদের প্রতি দ্রুত অঙ্গীকার বাস্তবায়নের দাবি জানানো হয়েছে পদযাত্রা থেকে।
আমাজন বন বাঁচানোর দাবিতে সম্মেলনের গ্রিন জোন এবং কপ ভিলেজে কায়াপো, টুপি-গুয়ারানি, টুপিনামা, তেম্বে, কায়াপো, হুয়ারানি, মুন্ডুরুকু, ইয়ানুমামিসহ আমাজন বনের আদিবাসী জনতা সম্মেলনের শুরু থেকেই নানা প্রতিবাদ কর্মসূচি করছেন।
মুনাফা না মানুষ, দম্ভ না দরদ?
গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর সপক্ষে কোনো সুস্পষ্ট অঙ্গীকার আনতে পারেনি বেলেম। অথচ আদিবাসী ও স্থানীয় জনগোষ্ঠীই ঐতিহাসিকভাবে এই পৃথিবীকে তাদের শ্রম, মেধা, মূল্যবোধ, আধ্যাত্মিকতা, দর্শন আর নৈতিকতা দিয়ে জাগিয়ে রেখেছেন। কিন্তু পৃথিবীর ইতিহাস এক নিদারুণ দম্ভ, দগদগে দাগ আর দুর্বৃত্তায়নের আখ্যান। প্রতিদিন এখানে মানুষ নয়, মুনাফাকে প্রতিষ্ঠা করা হয়। দরদ নয়, কর্তৃত্ববাদী দুর্বৃত্তায়নকে জারি রাখা হয়।
জলবায়ু সংকটের গল্প কোনোভাবেই কেবল আবহাওয়াবিজ্ঞান আর গবেষণাগারের বিষয় নয়। দুনিয়ায় জারি থাকা কাঠামোগত বৈষম্য, বহুমুখী বঞ্চনা, শ্রেণি ও বর্গীয় বিবাদ, বাইনারি বিভাজন, কলোনিয়াল লিগ্যাসি আর সামরিক উন্নয়নের ফলাফল। এসব বয়ান আড়ালে রেখে, বৈষম্য ও ক্ষমতার প্রবলতা চুরমার না করে কোনোভাবেই সবার জন্য কোনো ন্যায্য বার্তা আনতে পারবে না বেলেম সম্মেলন।
১৫ নভেম্বর আলাপ হয় ফিলিপাইনের নারীবাদী কর্মী আনা সেলেটিয়ালের সঙ্গে। তিনি বলেন, সাম্রাজ্যবাদ, পুঁজিবাদ ও পুরুষতন্ত্র পরিবেশ দূষণ করছে। একই সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনকে উসকে দিচ্ছে। বেশি ভোগান্তি পোহাচ্ছে দক্ষিণ গোলার্ধের আদিবাসী ও গ্রামীণ কৃষক নারী। লোকদেখানো কোনো অভিযোজন প্যাকেজ দিয়ে এই সংকট কাটবে না। দরকার সত্যিকারের রাজনৈতিক অঙ্গীকার।
নিরাপদ কৃষি চর্চাকারী ব্রাজিলের কৃষক কারিনা গঞ্জালেস ১৩ নভেম্বর এক আলোচনায় বলেন, বহুজাতিক কোম্পানি কৃষি ও খাদ্য উৎপাদনকে কৃষকের হাত থেকে কেড়ে নিচ্ছে। তারা খাদ্যব্যবস্থাকে বিষাক্ত ও অনৈতিক করে তুলছে। দ্রুত কৃষিকে আদিবাসী ও স্থানীয় জনগোষ্ঠীর কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
স্থানীয় খাদ্যসংস্কৃতি ও উপাদনব্যবস্থাকে জোরদার করতে আদিবাসী এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জীবনের সুরক্ষার দাবি জানান ব্রাজিলের গবেষক নাজারেস হেইস ১১ নভেম্বরের এক অধিবেশনে। ওই অধিবেশনে ব্রাজিলের প্রতিনিধি ফেব্রিসিও মুরিয়ানা, ফ্রান্সিন জেভিয়ার, বেলা গিল কিংবা ব্রুনা সারকুইয়েরাদের আলাপেও অধিকার সুরক্ষার বিষয় ওঠে আসে।
১৩ নভেম্বর অনুষ্ঠিত ‘দ্য সেন্ট্রাল রোল অব ইনডিজেনাস পিপলস অ্যান্ড লোকাল কমিউনিটিস ইন জাস্ট এনার্জি ট্রানজিশন’ শীর্ষক অধিবেশনে বক্তারা আদিবাসী ও স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে জ্বালানি শক্তি রূপান্তর¯প্রক্রিয়ার কেন্দ্রে রাখার মতামত দিয়েছেন।
অভ্যন্তরীণ অবদান (এনডিসি) এবং আদিবাসী ও স্থানীয় জনগণ
জলবায়ু পদযাত্রায় তরুণ আদিবাসী নেতারা স্লোগান দিয়েছেন, আদিবাসী জীবনের ন্যায়বিচার ছাড়া জলবায়ু ন্যায্যতা সম্ভব নয়।
বাংলাদেশ থেকে আসা মান্দি বা গারো জাতির তরুণ আদিবাসী নেতা টনি চিরান ১৫ নভেম্বর কপ-ভিলেজে বলেন, মধুপুর শালবনে ইকোপার্ক বা কৃত্রিম লেক কোনো সমাধান নয় প্রমাণিত হয়েছে, আদিবাসীদের সঙ্গে নিয়েই বন ও পরিবেশ ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলেতে হবে।
১২ নভেম্বর রাশিয়ার ‘সেন্টার ফর সাপোর্ট অব ইনডিজেনাস পিপলস অব দ্য নর্থের (সিএসআইপিএন)’ প্রতিনিধি দেইরা এগ্রেইভা রাশিয়ার এনডিসিকে বিশ্লেষণ করে জানান, সেখানে রাশিয়ার আদিবাসীদের অধিকার এবং অঞ্চলের জলবায়ু অভিজ্ঞতাকে যুক্ত করা হয়নি। তুষারপাতের পরিবর্তন এবং আদিবাসীদের মৌসুমভিত্তিক শিকার ও খাদ্য সংগ্রহের জটিলতা দূরকরণে এনডিসিতে কিছু নেই। আদিবাসীদের স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সঙ্গে একত্র করে গণ্য করা যাবে না, উভয়কে পৃথকভাবেই স্বীকৃতি দিতে হবে।
পেরুর আমাজন বনের আদিবাসী নারী নেটওয়ার্কের প্রতিনিধি ইনপুটানারি জাতির সদস্য কেটি মার্সেলো ১২ নভেম্বর এক অধিবেশনে বলেন, এনডিসি প্রতিবেদনে বহু জটিল শব্দ ব্যবহার করা হয়, যা আদিবাসীদের ঐতিহাসিক জ্ঞানকাণ্ডকে তুলে ধরতে পারে না। বিশেষ করে আদিবাসী নারীরা জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বেশি ভুক্তভোগী হলেও তাদের সংগ্রামকে যুক্ত করা হয়নি।
ইনডিজেনাস ইয়ুথ ফোরামের নৃবিজ্ঞানী কামিলা রুবেরু এনডিসি প্রক্রিয়ায় আদিবাসী যুবদের কার্যকর অংশগ্রহণ যুক্ত করার ওপর গুরুত্ব দেন ১৫ নভেম্বরের এক অধিবেশনে।
চাদের অ্যাসোসিয়েশন দ্যস ফার্মারস পিউলেস অ্যাট পিপলস অটোটোনসের (এএফপিএটি) প্রতিনিধি হিন্ডাউ ওমারাও ইব্রাহিমের সঙ্গে কথা হয় ব্লু জোনের ফুডকোর্ট জোনে। ১৪ নভেম্বর দুপুরের খাবার খেতে খেতে তিনি জানান, মরু অঞ্চলের পশুপালনজীবী ও যাযাবর আদিবাসী ও স্থানীয় জনগোষ্ঠীরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। ক্ষতিগ্রস্তদের সামগ্রিক সক্ষমতার বিষয়গুলো এনডিসিতে অনুপস্থিত।
১৫ নভেম্বর বাংলাদেশ থেকে আসা আদিবাসী প্রতিনিধিদের সঙ্গে বেলেম সম্মেলনে তাদের অভিজ্ঞতা জানার জন্য আলাপে বসি। রাতের খাবারে চাকমাদের নাপ্পি, হাজংদের লেবা ও মান্দিদের নাখাম কাবাব দিয়ে আমাদের আপ্যায়ন করা হয়। আদিবাসী তরুণেরা বাংলাদেশে নতুন সম্ভাবনার স্বপ্ন দেখেন। সংহতি ও ঐক্য জোরদারের আশা করেন। কাপেং ফাউন্ডেশনের পল্লব চাকমা বলেন, এনডিসিতে বহু বিষয় যুক্ত হয়েছে, যা আদিবাসীবান্ধব, কিন্তু কীভাবে পাহাড় ও সমতলে তা বাস্তবায়ন হবে, সেটি ঠিক করা দরকার।
আদিবাসী ও স্থানীয় জনগণের বৈশ্বিক সংহতি
বেলেম সম্মেলনের স্লোগান বৈশ্বিক মুটিরাও বা সম্মিলিত প্রচেষ্টার গল্পটি নেওয়া হয়েছে আমাজন বনের টুপি-গুয়ারানি আদিবাসীদের ভাষা থেকে। বাংলাদেশের আদিবাসীদের মুটিরাওগুলোকেও সমাজ, রাষ্ট্র এবং বৈশ্বিক প্রক্রিয়ায় যুক্ত করতে হবে। পাহাড়ি জুমে গ্রামের বহুজনে মিলে স্বেচ্ছাশ্রমে কাজ করার প্রথাগত রীতিকে চাকমা জনগোষ্ঠীর ভাষায় বলে ‘মালেয়া’। ম্রো আদিবাসীরা এই রীতিকে বলেন ‘তখং’। তঞ্চংগ্যা ভাষায় বলে ‘মালায়া’। তবে সম্মিলিত সামাজিক প্রচেষ্টাকে বলে ‘একলগে সেত্তা’।
ত্রিপুরাদের ককবরক ভাষায় বলে ‘চুবাচু বা জমাজরি’। বম ভাষায় বলে ‘ত্লাং রুয়াল নাক’ বা ‘ত্লম ঙেইহ্’। কৃষিকাজে সমষ্টিগত সহযোগিতাকে হাজং ভাষায় বলে ‘মাগনি কামলা’ বা ‘হাতভাড়া’। পাংখোয়া ভাষায় সম্মিলিত প্রচেষ্টা মানে ‘সাংছোয়াক’। খাসি ভাষায় ‘জিংত্রেই লাং’।
মান্দি বা গারো আদিবাসীদের আচিক ভাষায় ‘হামিল’ বা ‘রিমচাকা’ মানে সম্মিলিত সামাজিক উদ্যোগ। খুমি ভাষায় ভাংগ্রেই কালোপ বা আলুসা। আদিবাসী কোলরা বলেন ‘সানাম খোয়ায় মি সাঁওতে টমি কেদা কঃ’।
পৃথিবীকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য যারা সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ করে চলেছে; আশা করি, বেলেম সম্মেলন তাদের সঙ্গে বেইমানি করবে না।
পাভেল পার্থ: লেখক ও গবেষক
ই-মেইল: [email protected]