আঠা ছাড়া কাঁঠাল, বীজবিহীন পেয়ারা

আঠাবিহীন কাঁঠাল, বিচি ছাড়া পেয়ারা বা সাদা রঙের জামের গাছ লাগানো যাবে বাগানে, বাড়ির আঙিনায়, এমনকি শহুরে ফ্ল্যাটবাড়ির ছাদে
ছবি: তানভীর আহাম্মেদ

কাঁঠালে যদি আঠা না থাকে! পেয়ারা দেখতে একই রকম আছে কিন্তু ভেতরে নেই বিচি অথবা জাম কালো না হয়ে সাদা হলে খেতে কি অন্য রকম লাগবে? এসব এখন আর ‘যদি’, ‘কিন্তু’, ‘তাহলে’র বিষয় নয়, একেবারে নিরেট বাস্তব। আঠাবিহীন কাঁঠাল, বিচি ছাড়া পেয়ারা বা সাদা রঙের জামের গাছ নিজেই লাগাতে পারেন আপনার বাগানে, বাড়ির আঙিনায়, এমনকি শহুরে ফ্ল্যাটবাড়ির ছাদে। ছোট চারা থেকে ফল ধরা বড় গাছ—সবই পাওয়া যাচ্ছে জাতীয় বৃক্ষমেলায়।

৫ জুন রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে আগের বাণিজ্য মেলার মাঠে বন অধিদপ্তরের আয়োজনে শুরু হয়েছে জাতীয় বৃক্ষমেলা। প্রচণ্ড দাবদাহের কারণে প্রথম কয়েক দিনে এবার বৃক্ষমেলায় লোকসমাগম ছিল বেশ কম। গতকাল শুক্রবার থেকে আবহাওয়া একটু করে বদলাচ্ছে। বহুল প্রত্যাশিত কালো মেঘের আনাগোনা শুরু হয়েছে আকাশজুড়ে। রাজধানীতে হালকা বা মাঝারি বৃষ্টিও হচ্ছে দু-এক পশলা। তাতে জনজীবনে যেমন স্বস্তি ফিরেছে, তেমনি বৃক্ষমেলাতেও বেড়েছে বৃক্ষপ্রেমীদের আনাগোনা। আজ শনিবারও সকাল থেকেই ছিল মেঘমেদুর আবহাওয়া, উপরন্তু সাপ্তাহিক ছুটির দিন। গাছ কিনতে সকাল থেকেই অনেক ক্রেতার সমাগম হয়েছিল মেলায়।

এবার মেলার প্রতিপাদ্য, ‘গাছ লাগিয়ে যত্ন করি, সুস্থ প্রজন্মের দেশ গড়ি’। প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত মেলা খোলা। মেলার তথ্যকেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত ফরেস্ট রেঞ্জার আবু তারেক খন্দকার জানালেন, মেলা চলবে আগামী ১২ জুলাই পর্যন্ত। তবে মাঝখানে ২৮ থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত পবিত্র ঈদুল আজহা উপলক্ষে মেলা বন্ধ থাকবে। তিনি জানালেন, বন অধিদপ্তরের আয়োজনে বৃক্ষমেলা শুরু হয়েছিল ১৯৯৪ সালে। এর মধ্যে কোভিড সংক্রমণের কারণে শুধু ২০২০ ও ২০২১ সালে মেলা হয়নি। গত বছর থেকে আবার নিয়মিত মেলা হচ্ছে। এবার মেলার পরিসর ও অংশগ্রহণকারীদের সংখ্যা বেড়েছে। তথ্যকেন্দ্রের হিসাবে, গত বছর তিন কোটি টাকার বেশি চারা বিক্রি হয়েছিল। এবার তারা আশা করছে, বিক্রি আরও বাড়বে। গত বছর স্টল ছিল ১১৭টি, অংশ নেয় ৬৯টি প্রতিষ্ঠান। এবার স্টলের সংখ্যা ১২৪, আর ৭৫টি প্রতিষ্ঠান অংশ নিয়েছে।

কৃষিতে উন্নত প্রযুক্তির কল্যাণে হাইব্রিড জাতের ফলফলারির গাছই বেশি।
ছবি: প্রথম আলো

বৃক্ষমেলায় প্রবেশ করলে মনে হয় যেন ফলে, ফুলে সুশোভিত এক উদ্যান। প্রতিটি স্টলের ভেতরে আর সামনে হরেক রকমের ফলদ, বনজ, ঔষধি আর শোভাবর্ধনকারী গাছপালার নান্দনিক সমাবেশ। আমাদের দেশে গ্রীষ্মকাল ফলের মৌসুম বলেই খ্যাত। কৃষিতে উন্নত প্রযুক্তির কল্যাণে হাইব্রিড জাতের ফলফলারির গাছই বেশি। টবে লাগানোর উপযোগী ফলের গাছে গাছে ঝুলছে কাঁচা–পাকা আম, লিচু, জামরুল, করমচা, লটকন, জাম্বুরা, লেবুসহ হরেক রকমের ফল। এমনকি আপেল ধরা গাছও রয়েছে কোনো কোনো স্টলে। এসব হাইব্রিড ফলের গাছের সমারোহেই বৃক্ষপ্রেমীরা খুঁজে পাবেন আঠাবিহীন কাঁঠাল, বীজ ছাড়া পেয়ারা প্রভৃতি। এ ছাড়া রাম্বুটান, অ্যাভোকাডো, আলুবোখারা, ডুরিয়ান, ম্যাঙ্গোস্টিন, লঙ্কান, কেসুসসহ অনেক রকমের বিদেশি ফলের ছোট চারা বা ফল ধরা গাছও পাওয়া যাচ্ছে মেলায়।

জান্নাত নার্সারির মালিক খন্দকার শরিফুল আলম জানালেন, তাঁর স্টলে প্রায় ১১৫ প্রজাতির ফলদ, ৭২ প্রজাতির ভেষজ, ৪২ প্রজাতির বনজ এবং প্রায় ৩৫০ প্রজাতির শোভাবর্ধনকারী বিভিন্ন আকারের গাছ ও চারা রয়েছে।

বড় আকারের টবে ফল ধরা গাছগুলোর দাম গাছের জাত, আকার ও ফলের ওপর নির্ভর করে
ছবি: প্রথম আলো

নার্সারিমালিকেরা জানালেন, বড় আকারের টবে ফল ধরা গাছগুলোর দাম গাছের জাত, আকার ও ফলের ওপর নির্ভর করে। এর দাম ন্যূনতম ২ হাজার থেকে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত। ফলদ গাছের ছোট চারা ১০০ থেকে দেড় হাজার টাকার মধ্যে। তবে দেশি ফলের ছোট চারার দাম কম। ১০০ থেকে ২০০ টাকায় পাওয়া যায়। পলি ব্যাগের ফুলের চারার দাম বরাবর যা ছিল, এবারও তা–ই। গোলাপ, বেলি, চামেলি, জুঁই, কামিনী, গন্ধরাজ, টগর, নয়নতারা, অ্যালামন্ডা, ডায়ানথাস, জারবেরা, ল্যান্টানা প্রভৃতি ৩০ থেকে শুরু করে ১০০ টাকা পর্যন্ত। লাউ, ঝিঙে, করলা—এসব সবজির চারাও পাওয়া যায় ৩ থেকে ৫০ টাকায়। হরেক রকমের ক্যাকটাস, সাকুলেন্ট, অর্কিড রয়েছে প্রায় প্রতিটি স্টলেই। কেনা যাবে ১০০ থেকে ২ হাজার টাকার মধ্যে।

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শহীদুল ইসলাম খান মেলায় এসেছিলেন কিছু ফল আর সবজির চারা কিনতে। তিনি প্রথম আলোকে বললেন, বনানীতে তাঁর বাসার ছাদে টবে সবজির বাগান করেছেন। লাউ, কুমড়া বেশ ভালো হচ্ছে। এবার ঢ্যাঁড়স আর করলা লাগাবেন। কয়েকটি করে চারা কিনেছেন। আর কিনেছেন পেয়ারার চারা। বৃষ্টির জন্য অপেক্ষা করছিলেন। আবহাওয়া বদলাতেই মেলায় চলে এসেছেন।

ইদানীং ক্যাকটাস, সাকুলেন্ট, অর্কিড, নানা জাতের ইনডোর প্ল্যান্টের প্রতি ক্রেতাদের আগ্রহ তৈরি হচ্ছে
ছবি: প্রথম আলো

চারার দাম নিয়ে মোটামুটি সন্তুষ্ট সরকারি কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম। তিনি সস্ত্রীক মেলায় এসেছিলেন ছাদবাগানের জন্য ফলের গাছ আর সবজির বীজ কিনতে। মিরপুরের কাজীপাড়ায় তাঁদের নিজেদের বাড়ির ছাদে বাগান করেছেন বেশ কয়েক বছর থেকে। তাঁরা জানালেন, প্রতিবছরই কিছু কিছু করে চারা কেনেন। এবারও দামে খুব বেশি তারতম্য মনে হয়নি তাঁদের।

কলাবাগান থেকে মেলায় এসেছিলেন এসজিএস নামে একটি বিদেশি সংস্থার কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম। তিনি ৩ হাজার ৬০০ টাকায় কিনেছেন টবে লাগানো আপেলগাছ। বৃক্ষপ্রেমী মানুষ। নিজেদের বাড়ির ছাদে নানা রকম ফল ও দুর্লভ জাতের উদ্ভিদের বাগান গড়ে তুলেছেন বছর দশেক ধরে।

কথা হলো গ্রিন স্পেস নার্সারির কর্মকর্তা আরিফুর রহমান ও হোসেন নার্সারির মালিক সাদ্দাম হোসেনের সঙ্গে। তাঁরা জানালেন, মেলার শুরুর কয়েক দিনে প্রচণ্ড গরমের কারণে ক্রেতাদের উপস্থিতি কম ছিল আর গাছ লাগানোর জন্য আবহাওয়াও তেমন সুবিধাজনক ছিল না। বৃষ্টি শুরু হওয়ায় ক্রেতারা আসছেন। তাঁরা জানালেন, ঢাকায় সাধারণত বড় রকমের বনজ বা ফলদ গাছের চাহিদা কম। এখানে জায়গার স্বল্পতার জন্য ঘরের ভেতর, বারান্দা, ব্যালকনি বা ছাদে রাখা যায়, এমন গাছের বিক্রিই বেশি। হাইব্রিড ফল আর ইদানীং ক্যাকটাস, সাকুলেন্ট, অর্কিড, নানা জাতের ইনডোর প্ল্যান্টের প্রতি ক্রেতাদের আগ্রহ তৈরি হচ্ছে। থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, চীনসহ বিভিন্ন দেশ থেকে এসব চারা বা বড় গাছ নার্সারিমালিকেরা সরাসরি আমদানি করছেন। কেউ কেউ নিজেও চারা তৈরি করছেন।

বৃক্ষমেলায় একসঙ্গে অনেক রকমের গাছের চারার সঙ্গে সার, মাটি, টব, বীজ, বালাইনাশকসহ হরেক রকম কৃষি উপকরণও পাওয়া যায়
ছবি: প্রথম আলো

বৃক্ষমেলায় একসঙ্গে অনেক রকমের গাছের চারার সঙ্গে সার, মাটি, টব, বীজ, বালাইনাশকসহ হরেক রকম কৃষি উপকরণও পাওয়া যায়। মেলায় সহজলভ্যতার কারণেও শহরে বাগান করতে নাগরিকেরা আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। আজ দুপুরে মেলা পরিদর্শনে এসে এ কথাই বললেন বন বিভাগের বন সংরক্ষক ইমরান আহমেদ। তিনি জানালেন, এবার রাজধানীতে জাতীয় বৃক্ষমেলার পর প্রতিটি বিভাগীয় শহরে এবং বর্ষাকালজুড়ে সারা দেশেই জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে বৃক্ষমেলা হবে। সবুজ আচ্ছাদন তৈরিতে বৃক্ষমেলা বিশেষ ভূমিকা রাখছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।