চর-হাওর-উপকূল-পাহাড়ে নির্যাতনের শিকার ৩১% নারী

জলবায়ুঝুঁকিপূর্ণ এলাকার প্রায় ৩১ শতাংশ নারী গত বছর শারীরিক, মানসিক, অর্থনৈতিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। তবে নানামুখী নির্যাতনের ধরন সম্পর্কে সচেতনতার অভাবে তাঁরা অনেক সময় বুঝে উঠতে পারেন না যে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। ফলে ব্যাপক হারে নির্যাতনের ঘটনা ঘটলেও মাত্র ১৬ শতাংশ নারী অভিযোগ করেছেন। চর, হাওর, উপকূল ও পাহাড়ি এলাকায় মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন (এমজেএফ) পরিচালিত এক জরিপে এ তথ্য উঠে এসেছে। ‘কমিউনিটিভিত্তিক জলবায়ু সহনশীলতা ও নারীর ক্ষমতায়ন কর্মসূচি (ক্রিয়া)’ নামের প্রকল্পের আওতায় এ জরিপ পরিচালনা করা হয়।

আজ বুধবার এক ভার্চ্যুয়াল অনুষ্ঠানে ক্রিয়া প্রকল্পের বেজলাইন জরিপের ফলাফল তুলে ধরা হয়। জরিপে উপকূলীয়, চর, পার্বত্য ও হাওর এলাকার ১৪টি জলবায়ুঝুঁকিপূর্ণ জেলার ১৪ উপজেলার ২৮টি ইউনিয়নে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব দেখা হয়েছে। এই প্রভাব মোকাবিলায় ঝুঁকিপূর্ণ সম্প্রদায়গুলোর বর্তমান আর্থসামাজিক অবস্থা বিশেষ করে নারী ও মেয়েশিশুদের যেকোনো প্রয়োজনে সরকারি সংস্থাগুলো কীভাবে সাড়া দেয়, তা দেখা হয়েছে। নারীর ক্ষমতায়ন ও সচেতনতা বাড়ানো, নির্যাতন ও বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে সচেতনতা সৃষ্টি এবং অভিযোগের ক্ষেত্রে দ্রুত সাড়া দেওয়ার মাধ্যমে নির্যাতন প্রতিরোধ করার সুপারিশ করা হয়েছে জরিপ প্রতিবেদনে।  

জরিপে অংশ নেন ১ হাজার ২২ জন মধ্যবয়সী নারী-পুরুষ, যুব, তরুণ, কিশোর-কিশোরী, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী, প্রতিবন্ধী, রূপান্তরিত ও তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ। এর মধ্যে ৩৫ বছরের বেশি বয়সী নারী ও পুরুষের হার ছিল যথাক্রমে ৫১ ও প্রায় ২৩ শতাংশ। অংশগ্রহণকারীদের প্রায় ৬০ শতাংশ প্রাথমিক পর্যায় পর্যন্ত পড়েছেন। ১ শতাংশের কম ছিলেন স্নাতক পাস। প্রায় ৮৭ শতাংশ পরিবারই পুরুষপ্রধান।

অংশগ্রহণকারীদের ২৬ শতাংশ দিনমজুর। আর নারীদের মধ্যে ৩৯ শতাংশের বেশি গৃহবধূ।

অনুষ্ঠানে জানানো হয়, সুইডেন দূতাবাসের সহায়তায় এমজেএফ ২০২২ থেকে ২০২৬ সাল পর্যন্ত চার বছর মেয়াদি এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। প্রকল্পের উদ্দেশ্য হচ্ছে নারী ও কিশোরীদের দক্ষতা ও নেতৃত্ব বাড়ানো, সামগ্রিকভাবে জলবায়ু পরিবর্তন ও এর কারণে সৃষ্ট দারিদ্র্য মোকাবিলায় তাদের উপযোগী করা এবং বাল্যবিবাহ ও পারিবারিক সহিংসতা বন্ধ করা।

এমজেএফের পক্ষে মাঠপর্যায়ে জরিপের কাজ করে অ্যাসোসিয়েটস ফর ইনোভেটিভ রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (এআইআরডি) লিমিটেড। এএইআরডির প্রতিনিধি ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক বাপ্পী রহমান জরিপের ফলাফল উপস্থাপন করেন।

চেয়ারম্যানদের কাছে অভিযোগ বেশি

জরিপের ফলাফলে বলা হয়, সবচেয়ে বেশি অভিযোগ করা হয়েছে চর এলাকায়, এ হার ২৫। উপকূলীয় এলাকায় ১৩ শতাংশ ও হাওর এলাকা থেকে প্রায় ৯ শতাংশ অভিযোগ এসেছে। পাহাড়ি এলাকা থেকে কোনো অভিযোগ করা হয়নি। সবচেয়ে বেশি অভিযোগ করা হয়েছে গ্রাম্য সালিস এবং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের কাছে। কোনো কোনো নারী একাধিকবার একাধিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন এবং একাধিক জায়গায় অভিযোগ করেছেন।

জরিপে বলা হয়েছে, চেয়ারম্যান ও সদস্যদের কাছে অভিযোগ করেছেন প্রায় ৭০ শতাংশ। গ্রাম্য সালিসে অভিযোগ করেছেন ৫৯ শতাংশ। প্রায় ২৭ শতাংশ অভিযোগ করেছেন থানায়। এ ছাড়া সামান্য কিছু অভিযোগ করা হয়েছে নারী নির্যাতন প্রতিরোধ কমিটি, বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) এবং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাসহ (ইউএনও) অন্যদের কাছে। জরিপে আরও বলা হয়, পারিবারিক সহিংসতার ক্ষেত্রে অনেক নারী লোকলজ্জা ও সচেতনতার অভাবে তা প্রকাশ করেন না।

২৬ শতাংশ নারী ও মেয়েশিশু জানিয়েছেন, তাঁরা এলাকায় স্বাধীনভাবে চলাচল করতে পারেন। তবে তাঁরা কতটুকু দূরত্ব পর্যন্ত যেতে পারবেন, সেটা নির্ভর করে পরিবারের পুরুষ সদস্যের অনুমতির ওপর।  

ঝুঁকি মোকাবিলায় যা করা হয়
অংশগ্রহণকারীদের প্রায় ২৪ শতাংশ জানিয়েছেন, তাঁরা জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি মোকাবিলায় ফসল উৎপাদন ও জীবন–জীবিকায় পরিবর্তন আনার চেষ্টা করেছেন।

বাঁধ নির্মাণ, বৃষ্টির পানি ব্যবহার, লবণাক্ত পানি প্রতিরোধী ফসল উৎপাদন করে পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়াচ্ছেন। ১৭ শতাংশ নারী জানিয়েছেন, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাব বিবেচনায় রেখে ফসল বোনার সময়ে কিছুটা পরিবর্তন এনেছেন।

অংশগ্রহণকারীদের ৪৫ শতাংশ জানিয়েছেন, তাঁরা সরকারের সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির উপকারভোগী।

এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সুরক্ষা কর্মসূচির আওতাভুক্ত হচ্ছেন উপকূলীয় এলাকার অংশগ্রহণকারীরা।

তাঁদের প্রায় ৭১ শতাংশ কোনো না কোনো সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় রয়েছেন। চর এলাকার প্রায় ৩৯ শতাংশ, পাহাড়ি এলাকার প্রায় ৩৮ শতাংশ এবং হাওর এলাকার ১৬ শতাংশের বেশি বিভিন্ন সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতাভুক্ত। তবে তালিকাভুক্ত হতে ঘুষ দেওয়াসহ রাজনৈতিক দল ও স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিদের সঙ্গে সম্পর্ক থাকার প্রয়োজন হয় বলে অভিযোগ করেছেন অনেকে।

জলবায়ুঝুঁকিপূর্ণ এলাকার উপযোগী নানা ধরনের জীবিকার ব্যবস্থা ও বাজারজাত প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত করার মাধ্যমে দারিদ্র্য কমানো সম্ভব বলে মত প্রকাশ করা হয় জরিপ প্রতিবেদনে।

অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব লুবনা ইয়াসমীন বলেন, জরিপে যেসব সমস্যার কথা তুলে আনা হয়েছে, তা ভবিষ্যতের পরিকল্পনা নিতে কাজে আসবে।

জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি উত্তরণে আর কী কী পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন, সে পরিকল্পনা করতে পারবে সরকার। ঝুঁকি মোকাবিলায় বাংলাদেশে বছরে ১ হাজার ১০০ কোটি ডলার লাগবে। এই পরিমাণ অর্থ কোথা থেকে আসবে, সে প্রশ্ন রয়েছে। নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যেও সরকার ঝুঁকি মোকাবিলায় অনেক কাজ করছে।

সভাপতির বক্তব্যে এমজেএফের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনকে একটি যুদ্ধতুল্য অবস্থা বিবেচনা করে পদক্ষেপ নিতে হবে।

জলবায়ুঝুঁকিপূর্ণ এলাকার মানুষ এখন প্রান্তিক অবস্থানে। তাঁদের জন্য এমন পদক্ষেপ নেওয়া উচিত যাতে তাঁদের সামাজিক, পারিবারিক, অর্থনৈতিক ও জীবন–জীবিকার জায়গায় পরিবর্তন আসে। এ কাজে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে তরুণদের সম্পৃক্ত হওয়া উচিত। তরুণেরা যেন দায়িত্বশীল নাগরিক হয়ে ওঠেন এবং তাঁদের নিজেদের কিছু সময় সামাজিক কাজে ব্যয় করেন।

অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন সিরাজগঞ্জের বেলকুচি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আফিয়া সুলতানা কেয়া এবং বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার ইউএনও মো. রোকনুজ্জামান খান।

অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন এমজেএফের পরিচালক (কর্মসূচি) বনশ্রী মিত্র নিয়োগী।