এ ধরনের টর্নেডো সামনে আরও বাড়বে

আবহাওয়া অধিদপ্তরের জ্যেষ্ঠ আবহাওয়াবিদ আবদুল মান্নান। দুই যুগ ধরে ঘূর্ণিঝড়, কালবৈশাখী, টর্নেডো ও জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে তিনি গবেষণা করছেন। গত শনিবার মৌলভীবাজারের হাকালুকি হাওরে আঘাত হানা টর্নেডোর ধরন ও কারণ নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন এই আবহাওয়াবিদ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বিশেষ প্রতিনিধি ইফতেখার মাহমুদ

মৌলভীবাজারের হাকালুকি হাওরে টর্নেডোর আঘাত হানার মুহূর্ত
ছবি: সংগৃহীত

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: মৌলভীবাজারের হাকালুকি হাওরে আকাশ থেকে ফানেলের মতো একটি মেঘ নেমে আসতে দেখা গেছে। সেটি আদতে কী ছিল?

আবদুল মান্নান: এটি অবশ্যই একটি শক্তিশালী টর্নেডো ছিল। আমরা সাধারণত স্থলভাগে টর্নেডোর কথা শুনে অভ্যস্ত। কিন্তু আমাদের জলাভূমিগুলোয় এ ধরনের টর্নেডো আঘাত হেনে থাকে। দেশের উপকূলীয় এলাকা, বঙ্গোপসাগর ও জলাভূমিগুলোয় প্রায় প্রতিবছর ছোট ছোট টর্নেডো আঘাত হানার তথ্য আমরা পাই। তবে অন্য টর্নেডোর তুলনায় হাকালুকির টর্নেডোটি বেশ ব্যতিক্রম ছিল। এর ফানেলটির দৈর্ঘ্য কমপক্ষে ৫০০ মিটার বা আধা কিলোমিটার বলে মনে হয়েছে।

প্রশ্ন :

সাধারণত মার্চ থেকে মে মাসের মধ্যে দেশে কালবৈশাখী, বজ্রপাত ও টর্নেডো আঘাত হানে। বছরের এই সময়ে এ ধরনের টর্নেডোর আঘাত হানা কী ইঙ্গিত করে?

আবদুল মান্নান: এমনিতেই বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি ও জলবায়ু পরিবর্তনের নানা প্রভাব আমরা বাংলাদেশে দেখতে পাচ্ছি। গত জুন মাসে আমরা ভারতের চেরাপুঞ্জিতে এক দিনে প্রায় এক হাজার মিলিমিটার বৃষ্টিপাত দেখেছি। দেশের ভেতরেও অনেক স্থানে অস্বাভাবিক বৃষ্টি হয়েছে। এরপর আমরা দেখলাম ভরা বর্ষা মৌসুমে টানা দাবদাহ। তার মানে, আবহাওয়ায় অস্বাভাবিক সব ঘটনা ঘটছে। এ টর্নেডোও তার একটি উদাহরণ। দাবদাহের কারণে সিলেটের হাওর এলাকাগুলোয় এমনিতেই তাপমাত্রা বেশি ছিল। এ কারণে জলীয় বাষ্প দ্রুত ওপরের দিকে উঠে গিয়ে শূন্যতা তৈরি হয়। আর আকাশে মেঘ থাকায় প্রচুর জলীয় বাষ্প নিয়ে টর্নেডোটি আঘাত হানে।

আরও পড়ুন

প্রশ্ন :

অনেক টর্নেডো জলাভূমিতে আঘাত হানার পর তা আবার ভূমিতে ওঠে। এটি ঘুরেফিরে পানিতেই কেন ছিল?

আবদুল মান্নান: হ্যাঁ, এ টর্নেডো মূলত পানিতে আঘাত হেনে প্রায় তিন মিনিট স্থায়ী হয়ে তারপর দুর্বল হয়ে যায়। ভূমিতে না ওঠার কারণ হচ্ছে হাওরের বিশেষ ধরনের ভূপ্রকৃতি। এখানে পানির গভীরতা কম থাকে। পানির সামান্য নিচে কাদামাটির স্তর ছিল। যে কারণে পানিতে আঘাত হেনে তা ওই কাদামাটি পর্যন্ত পৌঁছানোর পর সেখানে সম্ভবত গর্ত করে শক্তি ক্ষয় করে ফেলে। যে কারণে টর্নেডোটি একটি নির্দিষ্ট স্থানে ছিল বলে মনে হয়েছে। বাতাসের ওই ঘূর্ণির সঙ্গে তৃণ, মাছসহ অন্যান্য জলজ প্রাণী টানেল দিয়ে ওপরের দিকে উঠে পড়ার কথা। তবে এটি দুর্বল হওয়ার পর সেগুলো আবারও নিচে নেমে যায়।

প্রশ্ন :

এটি ভূমিতে আঘাত করলে কী হতে পারত?

আবদুল মান্নান: এটি ভূমিতে আঘাত হানলে জীবন ও সম্পদের বড় ধরনের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা ছিল। মানিকগঞ্জের সাটুরিয়ায় ১৯৮৯ সালে ২৬ এপ্রিল বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম ভয়ংকর টর্নেডো আঘাত হানে। সেখানে হাজারখানেক মানুষ প্রাণ হারায়। লাখখানেক মানুষের বাড়িঘর ধ্বংস হয়। এরপর আমরা ২০১৩ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও ২০১৪ সালে নেত্রকোনায় টর্নেডো আঘাত হানতে দেখেছি। এ কারণে ভূমিতে আঘাত হানলে ক্ষয়ক্ষতি অনেক বেশি হতো।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: বাংলাদেশে টর্নেডো আঘাত হানার ধরনে কোনো পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছেন কি না?

আবদুল মান্নান: গত এক যুগে দেশে টর্নেডোর আঘাত হানার প্রবণতা বেড়েছে। আগে সাধারণত আমরা চার থেকে পাঁচ বছর পরপর টর্নেডো আঘাত হানতে দেখেছি। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোয় আমরা দেখছি, প্রায় প্রতিবছরই দেশের বিভিন্ন স্থানে ছোটখাটো টর্নেডো আঘাত হানছে। এতে স্থানীয়ভাবে ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে। বিশেষ করে জলজ টর্নেডোর পরিমাণ বেড়ে যেতে দেখছি। আর টর্নেডোর পূর্বাভাস এখনো সঠিকভাবে দেওয়া সম্ভব নয়। এ কারণে আমাদের টর্নেডোর ক্ষতি মোকাবিলার উপযোগী করে বাড়িঘর নির্মাণ করতে হবে। আর কোথাও টর্নেডো শুরু হলে পাকা ভবন ও শক্তিশালী কোনো অবকাঠামোর মধ্যে আশ্রয় নিতে হবে।