হঠাৎ দেখা চীনা লালগলা

চীনা লালগলার পুরুষের গলা ও বুকে কালোয় ঘেরা চুনিলাল ছোপছবি: লেখক

বছর দেড়েক আগের ঘটনা। শ্রীমঙ্গলের পক্ষিসঙ্গী খোকন থৌনাজামের ফোন—মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের কুরমা চা-বাগানে অতি বিরল এক পরিযায়ী পাখির দেখা মিলেছে। পাখিটিকে বহুদিন ধরে খুঁজছি। কাজেই ওর কথা শুনেই মন চঞ্চল হয়ে উঠল। ভাগনে জাহিনুল ইসলামকে নিয়ে দ্রুত শ্রীমঙ্গলে রওনা হলাম। বাস থেকে নেমেই খবর পেলাম, আরও তিনজন পরিচিত পক্ষী আলোকচিত্রী এসেছেন। কাজেই নাশতা সেরে দ্রুত কুরমার পথে অটোরিকশা ছোটালাম।

কুরমায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে সকাল সাতটা বেজে গেল। অটোরিকশা থেকে নেমে জায়গামতো চলে গেলাম। কিন্তু আধঘণ্টা অপেক্ষার পরও পাখিটির দেখা পেলাম না। ঘড়ির কাঁটায় ৭টা বেজে ৩২ মিনিট ১২ সেকেন্ড হতেই সামনের জলাভূমির পেছনের ঝোপ থেকে বহুল প্রতীক্ষিত কালোয় ঘেরা চুনিলাল গলার পাখিটি বেরিয়ে এল। কিন্তু সূর্যের আলোর ছটা তীব্রভাবে মুখের ওপর পড়ায় ভালো ছবি তোলা গেল না। পাখিটিও দ্রুত ঝোপের ভেতরে উধাও হয়ে গেল।

এরপর সারা দিন ওটির কোনো খোঁজ নেই। একে তো গরম, এর ওপর মুঠোফোনের নেটওয়ার্কের অভাবে অত্যন্ত বিরক্তিতে প্রায় ৯ ঘণ্টা কাটালাম। কিন্তু পাখিটির কোনো সাড়াশব্দ পেলাম না। মনে মনে বললাম, ‘আহা, বিকেলের নরম আলোয় পাখিটি এলে দারুণ সব ছবি তুলতে পারতাম।’ কিন্তু সেটি এল না। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে পায়ে ব্যথা শুরু হলো।

সঙ্গে থাকা দুজন আলোকচিত্রীর ঢাকায় ফেরার ট্রেনের টিকিট কাটা থাকায় অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাঁরা চলে গেলেন। রোদের আলো কমে আসছে। আরেকটু পর আর ভালো ছবি হবে না; কিন্তু পাখির দেখা নেই। তবে আশা ছাড়লাম না, ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম। ঘড়িতে বিকেল ৪টা ৫৩ মিনিট ২৪ সেকেন্ড। হঠাৎ সামনের ঝোপের একটি নলখাগড়ার ডালে একবিন্দু লালের নড়নচড়ন চোখে পড়ল।

বুঝতে আর বাকি রইল না কী ওটা? ধীরে ধীরে লাল বিন্দু স্পষ্ট হয়ে ছোট্ট একটি পাখির অবয়ব ধরল। ক্যামেরার শাটারে আঙুলের চাপ বাড়তে থাকল। নলখাগড়ার নিচের ডাল থেকে ধীরে ধীরে ওটি ওপরের ডালে উঠে এল। ২ মিনিট ১২ সেকেন্ডে ২০৬টি ছবি উপহার দিয়ে ঝোপের আঁধারে পাখিটি হারিয়ে গেল। নতুন একটি পাখি পাওয়ার আনন্দে সারা দিনের ক্লান্তি একনিমেষে চলে গেল!

কুরমায় দেখা পাখিটি এ দেশের এক বিরল পরিযায়ী পাখি। ওটির কোনো বাংলাদেশি নাম নেই। ইংরেজি নাম ‘চায়নিজ রুবিথ্রট’। পরিযায়ী পাখি লালগলা বা গুম্পিগোরার (সাইবেরিয়ান রুবিথ্রট) আত্মীয় এটি, পশ্চিমবঙ্গে যার নাম গুপিগলা। একসময় চায়নিজ রুবিথ্রট ও হিমালয়ান রুবিথ্রট একই প্রজাতি (হোয়াইট টেইলড রুবিথ্রট) হিসেবে গণ্য হতো। কিন্তু বর্তমানে ওরা আলাদা প্রজাতি। পশ্চিমবঙ্গে হোয়াইট টেইলড রুবিথ্রট পাহাড়ি গুপিগলা নামে পরিচিত। সেই হিসেবে এটিকে চীনা লালগলা বা গুপিগলা বলা যায়। ম্যাসসিক্যাপিডি গোত্রের পাখিটির বৈজ্ঞানিক নাম Calliope tschebaiewi। পাকিস্তান থেকে মিয়ানমার পর্যন্ত হিমালয়ান রেঞ্জ ও মধ্য চীনের পাখিটি শীতে অনিয়মিতভাবে সিলেট বিভাগের ঝোপঝাড়ে পরিযায়ী হয়।

মৌলভীবাজারের কুরমা চা-বাগানের নলখাগড়ার ডালে দর্শনীয় ভঙ্গিতে পুরুষ চীনা লালগলা
ছবি: লেখক

চীনা লালগলা ছোট আকারের শাখাচারী পাখি। দৈর্ঘ্য ১৪ থেকে ১৫ সেন্টিমিটার। পুরুষ ও স্ত্রী দেখতে আলাদা। মাথাসহ পুরুষের দেহের ওপরটা জলপাই বাদামি। কপাল ও ভ্রু সাদা। সুস্পষ্ট কালো গোঁফরেখা রয়েছে, যা লালগলা ও পাহাড়ি লালগলায় নেই। গলা ও চিবুকজুড়ে চুনিলাল ডিম্বাকার ছোপ, যার চারদিকে বুক বরাবর চওড়া কালো পট্টি। পেট ও দেহতল সাদা। কালো লেজের গোড়া ও আগা সাদা। পুরুষের তুলনায় স্ত্রী সাদামাটা। গলা ও চিবুকে চুনিলাল ছোপ নেই; বরং তা সাদা। দেহের ওপরটা বাদামি। দেহতল ধূসরাভ। সরু সাদা ভ্রুরেখা। কালচে বাদামি লেজের আগা সাদা। স্ত্রী-পুরুষনির্বিশেষে চোখ কালচে বাদামি, চঞ্চু কালো ও পা কালচে।

পাখিটি অত্যন্ত লাজুক। বনপ্রান্ত বরাবর ঘন ঝোপঝাড়, চা-বাগান, জলাভূমি ও স্যাঁতসেঁতে ঘাসবনে একাকী বা জোড়ায় লেজ উঁচিয়ে লাফিয়ে বেড়ায়। ভয় পেলে মুহূর্তেই ঝোপঝাড়ের ভেতরে ঢুকে পড়ে। পোকামাকড়, শূককীট, শামুক, টিকটিকি ইত্যাদি খায়। ‘চারক্’, ‘স্কিয়্যাপ’, ‘ইট-ইট’ ইত্যাদি কর্কশ স্বরের সঙ্গে নানা ধরনের মিষ্টি শিস মিলিয়ে ডাকে।

মে থেকে আগস্ট প্রজননকাল। এ সময় মূল আবাসভূমির পাথরের মধ্যে কিংবা ঝোপঝাড়ের নিচে বড়সড় গোলগাল বাসা বানায়। ডিম পাড়ে চার থেকে ছয়টি, রং লালচে দাগ-ছোপসহ নীলচে-সবুজ। স্ত্রী একাই তা দেয়। ডিম ফোটে ১৪ দিনে। মা–বাবা উভয়েই ছানার যত্ন নেয়। ছানাগুলো উড়তে শেখে প্রায় ১৬ দিনে। আয়ুষ্কাল চার বছরের বেশি।

  • আ ন ম আমিনুর রহমান, পাখি বন্য প্রাণী চিকিৎসাবিশেষজ্ঞ