শকুনের জন্য ভালোবাসা

হবিগঞ্জে শকুনের নিরাপদ খাবারের জন্য তৈরি ফিডিং স্টেশনে একঝাঁক শকুন
ছবি: লেখক

কাওয়াসটি নওয়াল পারাসি নেপালের সমতলভূমির একটি গ্রাম। ওই গ্রামে গবেষক বন্ধু কৃষ্ণা ভুষালের সঙ্গে গেছি ‘জটায়ু’ রেস্টুরেন্ট দেখতে। এই রেস্টুরেন্ট শকুনের জন্য তৈরি। ওই গ্রামের একটি সমন্বয় কমিটি বয়স্ক গরুগুলো নিয়ে একটি গোচারণ সেন্টারে রাখেন। নেপাল সরকার ওই গোচারণভূমি দিয়েছে। গরুগুলো স্বাভাবিকভাবে মারা গেলে, সেগুলো নিয়ে যাওয়া হয় রেস্টুরেন্টে। আর আকাশে ওড়া শকুনগুলো সেখানে পেটপুরে তা খেয়ে থাকে। শকুন বাঁচাতে গ্রামবাসীর দারুণ এক উদ্যোগ!

ভারতের হিমাচল প্রদেশের পিনজরে একটি শকুনের প্রজননকেন্দ্র গড়ে তোলা হয়েছে। বেশ কয়েকবার সেখানে গেছি। ভারতে আরও এ রকম পাঁচটি শকুন প্রজননকেন্দ্র আছে। প্রায় ছয় শর বেশি শকুন এসব প্রজননকেন্দ্রে আছে। পিনজরে সকাল হলেই সেন্টারটির পাশে গরু ফেলা হয়। বিভিন্ন অঞ্চলের শকুন ওই গরু খেয়ে যায়।

ভারত আর নেপালের এই বিরল অভিজ্ঞতা থেকে বাংলাদেশেও ২০১৪ সালে শকুনের জন্য ‘ফিডিং স্টেশন’ তৈরি করা হয় হবিগঞ্জের রেমা বনে। বন অধিদপ্তর ও আইইউসিএন বাংলাদেশ এই কাজ দেখভাল করে। ক্রয় করা গরু প্রজনন মৌসুমে মাসে দুবার ফেলা হয় ওই স্টেশনে। শকুনগুলো নিয়মিত তা খেয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তোলে।

নেপালের কাওয়াসটি নওয়াল পারাসি গ্রামে শকুনের জন্য তৈরি জটায়ু রেস্টুরেন্ট।

ভারতীয় উপমহাদেশে এ রকম ছোট ছোট উদ্যোগে এখনো প্রায় ১১ হাজার শকুন টিকে আছে। আশির দশকে এ অঞ্চলে শকুন ছিল প্রায় চার কোটি। মাত্র দুই দশকে শকুন হারিয়ে গেছে ৯৯ ভাগ। এখন বেশির ভাগ বাংলা শকুন টিকে আছে ভারতে। বাংলাদেশে আছে মাত্র ২৬০টি।

কেন শকুন প্রকৃতি থেকে হারিয়ে গেল? নব্বইয়ের দশকের শেষ ভাগে ভারতীয় গবেষক ভিবু প্রকাশ তাঁর গবেষণাপত্রে বলেন, ‘আকাশে আর শকুন নেই।’ এ রকম সময়েই আমাদের দেশের গ্রামগুলো শকুনশূন্য হয়ে পড়ে। গরুর ভাগাড়ে মরা গরুর দুর্গন্ধ ছড়ালেও তা খাওয়ার কেউ নেই।

প্রায় এত দশক গবেষণার পর আমেরিকার একজন গবেষক লিন্ডসে ওকস জানান, পশু চিকিৎসায় ব্যবহৃত ডাইক্লোফেনাক–জাতীয় ওষুধ ব্যবহারের ফলেই শকুন হারিয়ে গেছে। তার মানে গরুর কোনো চিকিৎসায় এ–জাতীয় ব্যথানাশক ওষুধ ব্যবহারের ফলে গরু যদি মারা যায়, আর যদি ওই মরা গরু শকুন খায়, তবে সব শকুন বিষক্রিয়ায় নিমেষেই মারা পড়ে। ডাইক্লোফেনাকের পাশাপাশি কিটোপ্রোফেন, এসিক্লোফেনাক ও ফ্লুনিক্সিনি–জাতীয় ওষুধও শকুনের মৃত্যুর কারণ বলে প্রমাণিত হয়েছে।

শকুন রক্ষায় ভারত, বাংলাদেশ, নেপাল ও পাকিস্তান সরকার মিলে একটি জোট গঠন করা হলো ২০১২ সালে। ২০০৬ সালে বাংলাদেশ ছাড়া তিনটি দেশে একযোগে পশুচিকিৎসায় ডাইক্লোফেনাক ওষুধ নিষিদ্ধ করা হলো। বাংলাদেশে নিষিদ্ধ করা হয় ২০১০ সালে। সরকারিভাবে এটি একটি বড় উদ্যোগ।

২০১৮ সালে আমরা উল্লিখিত ৪টি দেশের ওপর একটি জরিপ চালাই এবং গবেষণাপত্র প্রকাশ করি। দেখা যায়, বিষাক্ত ডাইক্লোফেনাকের ব্যবহার একেবারেই কমে গেছে পশু চিকিৎসায়। শকুনের সংখ্যা কিছুটা বেড়ে যাওয়ার ইঙ্গিতও পাওয়া যায়। শকুন রক্ষায় গত বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ সরকার আরেকটি ক্ষতিকর ওষুধ কিটোপ্রোফেনও নিষিদ্ধ করে।

আমার শৈশব কেটেছে নওগাঁর ছোট্ট একটি গ্রামে। আমি যে পাড়ায় বসবাস করতাম, তার ঠিক পূর্ব পাশে গরুর একটি ভাগাড় ছিল। গরু মারা গেলে সেখানে ফেলা হতো। ভাগাড়ের ঠিক পাশেই ছিল মস্ত বড় একটি শিমুলগাছ। ওই গাছ আর ভাগাড় ঘিরে একঝাঁক শকুন প্রায় সময়ই গ্রামে থাকত। মরা গরু ফেলা হলে নিমেষেই সাবাড় করে দিত। এ রকম ‘প্রকৃতির ঝাড়ুদার’ প্রকৃতিতে আর একটিও নেই। শুধু ওই গ্রামে নয়, এ–দেশের প্রায় সব গ্রামেই একসময় শকুন দেখা গেলেও এখন আর নেই। শকুনের এই অনুপস্থিতিতে প্রাকৃতিকভাবে জলাতঙ্ক, অ্যানথ্রাক্সসহ বেশ কিছু রোগের প্রার্দুভাব বেড়েছে।

শকুনের এই ভয়াবহ বিপদের দিনে মানুষ তার ভালোবাসার হাত বাড়িয়েছে। পশু চিকিৎসার জন্য ব্যথানাশক নিরাপদ ওষুধ মেলোক্সিক্যাম আবিষ্কৃত হয়েছে। ওই ওষুধ ব্যবহারে শকুনের কোনো ক্ষতি হয় না। ওষুধটির আবিষ্কারক মি. জারগেনকে আমরা বাংলাদেশে নিয়ে এসেছিলাম। কয়েকটি ওষুধ কোম্পানির সঙ্গে আমরা সভাও করেছি। বর্তমানে বেশ কয়েকটি কোম্পানির মেলোক্সিক্যাম বাজারে এসেছে। সম্প্রতি টলফামেনিক অ্যাসিডও শকুনের জন্য ভালো ওষুধ হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে।

সীমান্ত দীপু, বন্য প্রাণী গবেষক