‘বিষাক্ত’ সুন্দর আলকুশী

টাঙ্গাইলের সখীপুরের শালবনে আলকুশীর ফুল
ছবি: লেখক

‘মচর মচ্, মচর মচ্, মচর মচ্ ॥ আলাকুশী মালা গাঁথে/ পাশে প্রিয়া ভোগে বাতে,/ থেঁতো করে গোলমরিচ গো/ হচর হচ্, হচর হচ্, হচর হচ্॥’

কবি কাজী নজরুল ইসলামও মজেছিলেন আলকুশীর রূপে, ঔষধি গুণে। তবে আলকুশী ফলের ছোঁয়া জীবনে যে না পেয়েছে, সে বুঝবে না এর ‘প্রেম’ কতটা বেদনার। ফলের গায়ে যে সূক্ষ্ম পশমের মতো শুঁয়া থাকে, তাতেই লুকিয়ে আছে সেই বেদনা। শরীরের যেখানেই সেই শুঁয়া লাগুক, চুলকাতে চুলকাতে প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়।

আলকুশীর ফল পাকার সময় হলে এর খোসা থেকে পশমগুলো বাতাসে উড়তে শুরু করে। বনে থাকা বানর তা বুঝতে পারে। তাই সে সময় তারা দল বেঁধে সে জায়গা থেকে সটকে পড়ে। পাকা ফল ঝরে মাটিতে পড়লে আবার তারা সেখানে ফিরে আসে।

খুলনা, বাগেরহাট ও যশোর অঞ্চলে আলকুশীর স্থানীয় নাম দয়ারগুঁড়ো, নওগাঁ-নাটোরে এর নাম শুয়াগুঁড়া। এ ছাড়া অঞ্চলভেদে বিলাইখামচি, খামচি, বিলাইআঁচড়া, সোয়াস গুঁড়ি, বিচ্ছুটি ইত্যাদি নামে একে ডাকা হয়। উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম Mucuna pruriens, পরিবার ফ্যাবেসি।

আলকুশীর ফল

লাতিন শব্দ পিউরিয়েন্স মানে চুলকানোর অনুভূতি। মখমলের মতো ফলের খোসা, এ জন্য এর ইংরেজি নাম বেঙ্গল ভেলভেট বিন। বিন মানে শিম বা শুঁটি। কচি ফলের খোসার ওপরে খাটো শুঁয়া থাকে ও খোসা থাকে সবুজাভ, ধীরে ধীরে তা বাদামি-সোনালি মখমলের মতো হয়ে যায়। ফলগুলো থোকা ধরে শিমের মতোই। একটা ফলের মধ্যে শিমের মতো চার-পাঁচটা শক্ত বীজ থাকে, যা থেকে চারা হয়।

গ্রামাঞ্চলে বনজঙ্গলে আগে বেশ দেখা পাওয়া যেত। এখন সে রকম চোখে পড়ে না। সম্প্রতি টাঙ্গাইলের সখীপুরে শালবনে হেমন্তের এক দুপুরবেলায় দেখা হলো সেই ‘বিষাক্ত’ সুন্দর আলকুশীর সঙ্গে। বছর দশেক আগে দেখেছিলাম বান্দরবানে বালাঘাটা যাওয়ার পথের ধারে জঙ্গলে। বান্দরবানের পাহাড়ি জঙ্গলের ফুলের থোকা ছিল অনেক বড়, অনেক ফুল বেণির মতো হওয়ায় দুলছিল।

সখীপুরের শালবনে যার দেখা পেলাম, সেই থোকায় ফুলের সংখ্যা কম, চার থেকে ছয়টা।

ফুলের পাপড়ি পাকানো, রং ঘন বেগুনি, গোড়ার দিকটা হালকা গোলাপি, ফুলের মাথার দিকে ছোট্ট একটি সাদা অংশ ইঁদুরের দাঁতের মতো বেরিয়ে আছে পরাগায়নের জন্য উন্মুখ হয়ে। থোকা ধরা ফল ঝুলছে লতার গিঁটে গিঁটে। লতা পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে বেয়ে চলেছে এক গাছ থেকে আরেক গাছে।

শিমগাছের পাতার মতো পাতা, একটা বোঁটায় তিনটি। পাতার ফলকের আকৃতি কিছুটা হীরকের মতো। পাতার রং সবুজ, অগ্রভাগ ভোঁতা, ওপর-পিঠ মসৃণ, নিচের পিঠ হালকা রোমশ।

বুকে জমা কফ সারাতে এর শিকড় ব্যবহার করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রে আলকুশীর বীজ ভেজে গুঁড়া করে কফির মতো পানীয় হিসেবে কেউ কেউ খায়। এতে প্রজননক্ষমতা বাড়ে।

মৃত্যুঞ্জয় রায়, কৃষিবিদ ও প্রকৃতিবিয়ক লেখক