বনিপদের দেখা পেলাম

রাংসা নদীর ধারে বনিপদগাছছবি: লেখক

গত ঈদুল আজহার ছুটিতে বাড়ি গিয়েছিলাম। ৫ জুন শেষ বিকেলে গেলাম ময়মনসিংহের তারাকান্দা উপজেলা সদরের দক্ষিণে রাংসা নদীর ব্রিজের কাছে। কিছুক্ষণ দাঁড়ালাম সেখানে। দুই দিকে নদীতে কচুরিপানার আবরণ। মাঝেমধ্যে জাল দিয়ে মাছ ধরার বাঁশের ফ্রেম চোখে পড়ল। নদীর ধারে ছায়াঢাকা গ্রাম। পশ্চিম আকাশে সূর্য তখন অস্তাচলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। পাখিরা উড়ছে নীড়ে ফেরার জন্য। মনোরম পরিবেশ।

বেশ কিছু সময় ব্রিজের ওপর কাটিয়ে ব্রিজ পেরিয়ে নদীর ধারের কাঁচা সড়ক দিয়ে পূর্ব দিকে হাঁটতে শুরু করলাম। যাঁরা ঢাকা থেকে ময়মনসিংহ হয়ে হালুয়াঘাট, ফুলপুর, নালিতাবাড়ী কিংবা শেরপুরে যান, তাঁদের কাছে এই ব্রিজ পরিচিত।

হাঁটতে হাঁটতে দেখছিলাম নদীর ধারের গাছপালাগুলো। নদীর স্বচ্ছ পানিতে পানিকলাসহ কিছু নিমজ্জিত জলজ উদ্ভিদ চোখে পড়ল। হঠাৎ নদীর ধারে একটি গুল্ম বা ঝোপালো গাছে নিমের মতো ফল ও চমৎকার সাদা রঙের ফুল দেখতে পেলাম। আরে, এ যে বনিপদ! ছবি তুলে ফেললাম ঝটপট। বাড়ির পেছনের জঙ্গলের ধারে বা নদীর ধারে সাধারণত এ উদ্ভিদ দেখা যায়। এর কাঠ নরম এবং ভালো মানের নয়, তাই শুধু জ্বালানি হিসেবে একে ব্যবহার করা হয়। আর এ উদ্ভিদের ভেষজ গুণ অনেকেরই জানা না থাকায় বাড়ির পেছনের বা নদীর ধারের ঝোপঝাড় কেটে ফেলার কারণে বনিপদের বংশবৃদ্ধি খুব সংকুচিত হয় পড়েছে। এ উদ্ভিদ সংরক্ষণে আমাদের সচেতন ও যত্নবান হওয়া দরকার।

বনিপদ গুল্ম বা ছোট বৃক্ষজাতীয় উদ্ভিদ। এ উদ্ভিদের বৈজ্ঞানিক নাম Alangium chinense, এটি Cornaceae পরিবারের সপুষ্পক গুল্ম। এ উদ্ভিদের অন্য নাম অক্ষিফলা। নেপালি ভাষায় একে বামনপাত্তি বলা হয়। ইংরেজিতে এ উদ্ভিদ সাধারণত চায়নিজ অ্যালানজিয়াম বা মার্লিয়া নামে পরিচিত। আকরকণ্ট অনেকের কাছে পরিচিত। আকরকণ্ট আর বনিপদ একই গোত্র আর গণের উদ্ভিদ।

উদ্ভিদটি উচ্চতায় ১৫ থেকে ২৫ ফুট পর্যন্ত হতে পারে। শাখা–প্রশাখা অনুভূমিক। ছোটবেলায় শাখা–প্রশাখাগুলো রোমশ থাকে, পরে চকচকে বা খুব কমই রোমশ হয়। পাতা মোটা, চিরসবুজ, মূলত ডিম্বাকার, রোমশ, নিচের পৃষ্ঠটি চকচকে। পাতার কিনারা দাঁতের মতো খাঁজকাটা, শীর্ষভাগ তীক্ষ্ণ। ফুল সুগন্ধযুক্ত, পাপড়ি সাদা থেকে কমলা রঙের, চকচকে, বাঁকানো। ফুলের ভেতরে হলুদ কেন্দ্র থাকে। ফল উপবৃত্তাকার, পাকলে গাঢ় বেগুনি রঙের হয়।

বনিপদগাছের ফলসহ শাখা
ছবি: লেখক

পাতাগুলো উজ্জ্বল তাজা সবুজ। এর কাণ্ডের অনেকটা নিচ থেকে এর ডালপালা বের হয়। তাই এটিকে ঝোপ বা গুল্মের মতো দেখা যায়। একে চীন, বাংলাদেশ, ভারতবর্ষ, নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা ও মিয়ানমারে দেখতে পাওয়া যায়। এর পাতা বেশ বড়, দেখতে ম্যাপল, উলটকম্বল ও গামারিগাছের পাতার মতো।

বাংলাদেশ ও ভারতে মে মাস থেকে এর ফুল ফোটে। ফুলের রং সাদা। এর ফল দেখতে অনেকটা নিমের ফলের মতো, তবে এর বীজ চ্যাপটা। পাকলে কালো রঙের হয়। চায়নিজ হারবাল মেডিসিনের মধ্যে এটি উল্লেখযোগ্য। হুনান হারবাল মেডিসিনে এটি সাপের কামড়, রক্ত সঞ্চালন, গর্ভনিরোধ, বাত ও ব্যথার চিকিত্সায় ব্যবহৃত হয়। এর বীজের তেলকে প্রদীপের জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে।

বনিপদের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভেষজ গুণ রয়েছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ঐতিহ্যবাহী ওষুধে বাত, চর্মরোগ ও ডায়াবেটিসের মতো রোগের জন্য উদ্ভিদটির ব্যবহারের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। বাংলাদেশে এ উদ্ভিদ ঐতিহ্যগতভাবে পেটব্যথা, বাত, চর্মরোগ ও ডায়াবেটিসের চিকিৎসাসহ বিভিন্ন ঔষধি উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়। এ ছাড়া উদ্ভিদটি ক্ষত, সাপের কামড় ও আঘাতজনিত সমস্যায় চিকিৎসার জন্যও ব্যবহৃত হয় বলে জানা যায়। পেটের ব্যথার জন্য মূল ও পাতার ক্বাথ ব্যবহার করা হয়।

  • চয়ন বিকাশ ভদ্র: অধ্যাপক, উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগ, মুমিনুন্নিসা সরকারি মহিলা কলেজ, ময়মনসিংহ