দীর্ঘ ভ্রমণকারী পাখিরা

টানা প্রায় ১১ হাজার কিলোমিটার উড়ে বিশ্ব রেকর্ড করেছে এই দাগিলেজ জৌরালি। ছবিটি মহেশখালীর সোনাদিয়া দ্বীপ থেকে তুলেছেন সায়েম ইউ চৌধুরী।

সুইডেনের কালমার শহর থেকে প্রায় ১৫০ কিলোমিটার দূরে বাল্টিক সমুদ্রের ভেতর একটি ছোট্ট দ্বীপের নাম ওটনবি। দ্বীপটি হাজারো পরিযায়ী পাখির এক বিশাল আশ্রয়স্থল। বাল্টিক সাগরজুড়ে যেসব পাখি দীর্ঘ পরিযায়ন করে, তাদের বিশ্রাম আর খাবারের জন্য এই এক খণ্ড ভূমিই শেষ ভরসা।

বছর দুয়েক আগে শরতের শেষ ভাগে এই ওটনবিতে গিয়েছিলাম পাখি গবেষণার কাজে। পরিযায়ী হাঁস আর সৈকত–পাখি ছাড়াও শত শত ফুটকি আর চুটকি প্রজাতির পাখি দেখলাম। একটানা ভ্রমণের কারণে পাখিগুলো এতই ক্লান্ত হয়ে পড়ে যে তাদের হাত দিয়েও ধরা যায়। বেশ কয়েক জাতের ফুটকি দেখলাম, যে পাখিগুলো শীতে আমাদের দেশের হাওর এলাকার জলাবনে দেখা যায়। মাত্র কয়েক গ্রাম ওজনের এসব পাখি কীভাবে এত দূর ভ্রমণ করে, তা কিছুতেই মাথায় আসে না।

ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আমাদের অঞ্চলে পাখি পরিযায়ন হয় না বললেই চলে। তবে রাশিয়া ও সাইবেরিয়ার তুন্দ্রা অঞ্চল থেকে শুরু করে তিব্বত, চীন ও মঙ্গোলিয়ার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে শীতে পাখিরা আমাদের দেশে পরিযায়ন করে। এক বছরে এই পুরো পথ পাখিদের দুবার ভ্রমণ করতে হয়। দীর্ঘ এই পথের দৈর্ঘ্য প্রায় ৯ হাজার কিলোমিটার। সাধারণত আমাদের অঞ্চলে এই পরিযায়ী পাখিরা প্রায় সাত মাস থাকে। বাকি সময়টুকু তুন্দ্রা অঞ্চলে প্রজননকাল সম্পন্ন করে। এই হলো পরিযায়ী পাখির জীবন। এ রকম পাখি প্রজাতি আছে আমাদের দেশে তিন শতাধিক।

শীতের শুরুতে আসা পাখিরা অনেকটা দুর্বল ও ক্লান্ত থাকে। এ সময় পাখিদের জন্য অধিক বিশ্রাম ও খাবারের প্রয়োজন হয়। গত ২৬ সেপ্টেম্বর মহেশখালী উপকূলে কালালেজ জৌরালি নামের এক ক্লান্ত পরিযায়ী পাখি স্থানীয় মানুষের হাতে আটকা পড়ে। এই পাখির পিঠে লাগানো ছিল একটি স্যাটেলাইট যন্ত্র। গবেষক দিলীপ দাশ গত বছরের ৩০ ডিসেম্বর এই পাখির গায়ে যন্ত্রটি বসিয়েছিলেন। এ বছরের ২৩ মে আমাদের উপকূল থেকে পরিযায়ন শুরু করে ২৮ মে পৌঁছায় তুন্দ্রা এলাকায়। পাখিটি প্রায় ছয় হাজার কিলোমিটার ভ্রমণ করেছিল। স্থানীয় লোকজন ভেবেছিল পাখিটিকে মিয়ানমার সরকার কোনো স্পাই হিসেবে পাঠিয়েছে। এই নিয়ে হইচই পড়ে গেল সেদিন। বন অধিদপ্তরকে আসল তথ্য জানানো হলো। তারপর উদ্ধার করা হলো পাখিটিকে। কিন্তু ক্লান্ত পাখিটি অবমুক্ত করার আগেই মারা গেল। মানুষের অতি উৎসাহের বলি হলো এই প্রিয় পরিযায়ী পাখি।

পরিযায়ী পাখিদের জীবন এমনই। কোথায় যে তাদের জীবনপ্রদীপ নিভে যাবে, তা বলা মুশকিল। ইউরোপ ও রাশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে বছরের একটি নির্দিষ্ট সময় পাখি শিকারের জন্য অনুমতি দেওয়া হয়। গত বছর পর্তুগালের একটি হ্রদ থেকে একটি মা নীলশির হাঁসকে ট্যাগ করা হয়েছিল। পাখিটি বাচ্চা ফোটাতে পরিবারসহ স্পেনের একটি অঞ্চলে যায়। মাত্র এক দিনের মাথায় মা পাখিটি শিকারের কবলে পড়ে। বাচ্চা পাখিগুলোর জীবনে কী ঘটেছে, তা জানা যায়নি।

দাগিলেজ জৌরালি নামের একটি সৈকত–পাখি এখন পর্যন্ত দীর্ঘ ভ্রমণকারী পাখি বলে গবেষণায় জানা যাচ্ছে। একটানা ৯ দিন উড়ে প্রায় ১১ হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে বিশ্ব রেকর্ড করেছে পাখিটি। এ সময় পাখিটি কোনো কিছু না খেয়ে, না ঘুমিয়ে আলাস্কা থেকে নিউজিল্যান্ড পৌঁছায়। এই পাখি প্রজাতির কিছুসংখ্যক আসে এ দেশের মহেশখালীর সোনাদিয়া দ্বীপে। এই দ্বীপে আরও একটি পাখি আসে, যার নাম চামচঠুঁটো বাটান। রাশিয়ার চুকটকা নামের একটি গ্রামে গ্রীষ্মে ডিম পেড়ে বাচ্চা ফোটায় মাত্র ৩০ গ্রাম ওজনের ছোট্ট এই পাখি। মাত্র ২০০ জোড়ার কম পাখি টিকে আছে পৃথিবীজুড়ে। আমাদের সোনাদিয়া দ্বীপটি এই মহাবিপন্ন পাখিটির টিকে থাকার জন্য খুবই জরুরি। এভারেস্টের মতো সবচেয়ে উঁচু পাহাড়ের ওপর দিয়ে উড়ে যাওয়া একমাত্র হাঁস প্রজাতি হলো দাগি রাজহাঁস। বিশাল দেহের এই হাঁসের দেখা মেলে আমাদের উপকূলে। উত্তর মঙ্গোলিয়ায় এরা গ্রীষ্মে প্রজনন সম্পন্ন করে।

আমাদের পরিযায়ীরা আমাদেরই পাখি। দীর্ঘ ভ্রমণ শেষে পাখিগুলো এসে যদি আমাদের টাঙ্গুয়ার হাওরের এক খণ্ড জলাভূমি অথবা সোনাদিয়ার মতো ছোট্ট এক ফালি সৈকতের ভূমি খুঁজে না পায়, তাহলে তাদের টিকে থাকা হয়ে পড়ে খুবই কঠিন।