সীতাকুণ্ডে ইকোপার্কের পাশে বর্জ্য শোধনাগার নির্মাণ নিয়ে প্রশ্ন 

শোধনাগারের জন্য ২০ একর জায়গা নির্ধারণ। ২০২৫ সালের ডিসেম্বরের দিকে নির্মাণকাজ শুরুর পরিকল্পনা।

চট্টগ্রাম জেলার মানচিত্র

চট্টগ্রাম জেলায় ছোট–বড় মিলিয়ে ১ হাজার ৩০০ কলকারখানা রয়েছে। এসব কারখানার বর্জ্য ধ্বংস করার জন্য পরিশোধনাগার নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে শিল্প মন্ত্রণালয়। তবে প্রকল্প স্থানের এক পাশে বোটানিক্যাল গার্ডেন ও ইকোপার্ক। আরেক পাশে চন্দ্রনাথ পাহাড়। জনবসতিপূর্ণ ওই এলাকায় শোধনাগার নির্মাণ করা নিয়ে ইতিমধ্যে আপত্তি উঠেছে।

নথি অনুযায়ী, প্রকল্পের নাম ‘এস্টাবলিশমেন্ট অব ট্রিটমেন্ট স্টোরেজ অ্যান্ড ডিসপোজাল ফ্যাসিলিটি (টিএসডিএফ) ফর শিপ রিসাইক্লিং ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যান্ড আদার্স ইন চিটাগং’। এতে অর্থায়ন করবে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা)। জাইকার পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ‘নিউ ভিশন সলিউশন লিমিটেড’ প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ করছে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সীতাকুণ্ড পৌরসভার বোটানিক্যাল গার্ডেন ও ইকোপার্ক সংলগ্ন মৌলভীপাড়ার পাহাড়ের পাদদেশে বর্জ্য শোধনাগারের জন্য ২০ একর জায়গা নির্ধারণ করা হয়েছে। এ জায়গা ঠিক করে দিয়েছে জাহাজভাঙা শিল্প মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ শিপ ব্রেকার্স অ্যান্ড রিসাইক্লার্স অ্যাসোসিয়েশন। প্রকল্প স্থান থেকে ইকোপার্ক ও বোটানিক্যাল গার্ডেনের দূরত্ব ১০ ফুটের মতো।

এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় বর্জ্য শোধনাগার তৈরি করলে পরিবেশ হুমকির মুখে পড়বে বলে আপত্তি জানিয়েছেন চট্টগ্রাম-৪ (সীতাকুণ্ড ও চট্টগ্রাম নগরের আংশিক) সংসদ সদস্য এস এম আল মামুন ও সীতাকুণ্ড পৌরসভার মেয়র বদিউল আলম।

এ ছাড়া প্রকল্পটির পরিবেশগত ক্ষতির আশঙ্কা করে গত ৮ ফেব্রুয়ারি বোটানিক্যাল গার্ডেন ও ইকোপার্কের পরিচালক বরাবর চিঠি দেন পার্কটির পর্যটন রেঞ্জের রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. আলাউদ্দীন ও পুনর্বাসন রেঞ্জের রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. মাসুম কবীর। চিঠিতে তাঁরা উল্লেখ করেছেন, ওই এলাকায় বর্জ্য শোধনাগার নির্মিত হলে পরিবেশগত সমস্যা হবে। বর্জ্যবাহী গাড়ি চলাচল করলে পর্যটক কমে যাবে। এ ছাড়া প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হবে এবং গাছপালা ও বন্য প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে যাবে।

পরিবেশবিদেরাও বলছেন, জাহাজভাঙা শিল্প প্রতিষ্ঠান ও কলকারখানার ঝুঁকিপূর্ণ বর্জ্য ওই এলাকায় পরিশোধন করা হলে নানা বিপদ হতে পারে।

তবে পরিবেশের ক্ষতি করে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে না বলে মন্তব্য করেছেন শিল্প মন্ত্রণালয়ের জাহাজ পুনঃপ্রক্রিয়া অনুবিভাগের যুগ্ম সচিব প্রতাপ চন্দ্র বিশ্বাস। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ইতিমধ্যে সীতাকুণ্ডের অংশীজনদের সঙ্গে সভা হয়েছে। সবার মতামত নেওয়া হয়েছে। কারও মতামত উপেক্ষা করে মন্ত্রণালয় কোনো সিদ্ধান্ত নেবে না। তিনি জানান, পরিশোধনাগার তৈরি প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ চলছে। ২০২৫ সালের ডিসেম্বরের দিকে নির্মাণকাজ শুরুর প্রাথমিক আলোচনা চলছে।

প্রকল্পে যুক্ত ব্যক্তিরা বলছেন, কয়েকটি ধাপে বর্জ্য পরিশোধন করা হবে। প্রথমে ৮০০ থেকে ১২০০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় সব ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ বর্জ্য পোড়ানো হবে। পোড়ানোর ফলে উৎপন্ন ধোঁয়াও পরিশোধন করে নির্গমন করা হবে। পাশাপাশি উৎপন্ন তাপ থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে। এ বিদ্যুৎ অভ্যন্তরীণ কাজে ব্যবহার করা হবে। দ্বিতীয় ধাপে উৎপন্ন ছাই ল্যান্ডফিল প্ল্যান্টে নিয়ে যাওয়া হবে। সেখানে এ ছাই বা বর্জ্য পরিশোধন করা হবে। তৃতীয় ধাপে ইটিপি প্ল্যান্টের মাধ্যমে শিপইয়ার্ডের বর্জ্য ও দূষিত পানি পরিশোধন করা হবে।

পরিশোধনাগার যে কারণে

সীতাকুণ্ডে আশির দশকে গড়ে ওঠা জাহাজভাঙা খাতকে ২০১১ সালে শিল্প ঘোষণা করা হয়। একসময় সীতাকুণ্ডে প্রায় ১৫০টি শিপইয়ার্ড কারখানা ছিল। বর্তমানে মাত্র ২৫টির মতো ইয়ার্ড চালু আছে। এ ছাড়া জেলা শিল্প পুলিশের হিসাবে, সীতাকুণ্ড উপজেলায় ছোট-বড় মিলিয়ে মোট ২৩৯টি শিল্পকারখানা রয়েছে। সীতাকুণ্ড বাদে চট্টগ্রামের অন্য উপজেলায় কারখানার সংখ্যা প্রায় ১ হাজার ১০০।

জাহাজভাঙা শিল্পের পরিবেশগত ও স্বাস্থ্যগত নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ২০০৯ সালে হংকং কনভেনশন চালু হয়। বাংলাদেশ গত বছরের ২৫ জুন এ কনভেনশনে সই করে। হংকং কনভেনশন অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জুনের মধ্যে সবগুলো জাহাজভাঙা কারখানাকে গ্রিন শিপব্রেকিং ইয়ার্ডে (সবুজ জাহাজভাঙা কারখানা) রূপান্তর করতে হবে। নইলে ওই বছরের জুলাই থেকে ভাঙার জন্য বিদেশ থেকে স্ক্র্যাপ জাহাজ আমদানি করতে পারবে না দেশীয় জাহাজভাঙা কারখানাগুলো। 

সবুজ জাহাজভাঙা কারখানা নির্মাণের অন্যতম শর্ত হলো পরিশোধনাগার থাকা। ইতিমধ্যে মাত্র চারটি প্রতিষ্ঠান পরিবেশবান্ধব জাহাজভাঙা কারখানার স্বীকৃতি পেয়েছে। বাকি প্রতিষ্ঠানগুলো এখনো এ স্বীকৃতি পায়নি। এ কারণে সমন্বিত পরিশোধনাগার নির্মাণের এ উদ্যোগ নেয় শিল্প মন্ত্রণালয়।

জাহাজভাঙা শিল্পমালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ শিপব্রেকার্স অ্যান্ড রিসাইক্লার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএসবিআরএ) সচিব মো. নাজমুল প্রথম আলোকে বলেন, ইতিমধ্যে যে চারটি কারখানা গ্রিন শিপব্রেকিং ইয়ার্ড হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে, তারা নিজেদের ব্যবস্থাপনায় বর্জ্য পরিশোধন করে।

বাংলাদেশ শিপ রিসাইক্লিং বোর্ডের একটি প্রকল্প প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সীতাকুণ্ডের জাহাজভাঙা কারখানাগুলোতে প্রতিবছর গড়ে ১৪ হাজার ৮০০ মেট্রিক টন বিভিন্ন রকমের বর্জ্য তৈরি হয়। জাহাজভাঙা কারখানা ছাড়া বাকি কারখানাগুলোতে উৎপন্ন হয় গড়ে ৬৮ হাজার ৬০০ মেট্রিক টন বর্জ্য। এসব বর্জ্য পরিশোধন ছাড়াই সমুদ্র, খাল ও নালায় চলে যাচ্ছে।

সীতাকুণ্ডের এসএল শিপব্রেকিং ইয়ার্ডের মালিক মোহাম্মদ লোকমান প্রথম আলোকে বলেন, বর্জ্য শোধনাগার নির্মাণের জন্য শিল্প মন্ত্রণালয় সহযোগিতা চেয়েছিল। সীতাকুণ্ডে দুটি ও মিরসরাইয়ে একটি জায়গা প্রস্তাব করা হয়। এরপর মন্ত্রণালয় ও জাইকা পৌরসভার স্থানটি উপযোগী মনে করে। তারা দুই বছর ধরে সেখানে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছে। কয়েক দফায় মাটিও পরীক্ষা করা হয়েছে। এরপরই মূলত স্থানটিকে নির্বাচন করা হয়েছে।

জায়গা নিয়ে আপত্তি

বর্জ্য শোধনাগার নির্মাণে ছাড়পত্র দেওয়ার জন্য গত ৪ এপ্রিল পৌর মেয়র বদিউল আলমের কাছে চিঠি দেয় শিল্প মন্ত্রণালয়। পরে ২৩ এপ্রিল পৌর ওয়ার্ডের কাউন্সিলরদের নিয়ে সভা হয়। এতে প্রকল্প বাস্তবায়নে ছাড়পত্র না দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।

ছাড়পত্র না দেওয়ার বিষয়ে মেয়র বদিউল আলম প্রথম আলোকে বলেন, কারখানার বর্জ্য ধ্বংসে পৌর এলাকার বাসিন্দাদের দুর্ভোগ পোহাতে হবে। তা ছাড়া দুর্গন্ধে পরিবেশের ক্ষতি হবে। আবার ভূগর্ভস্থ পানির স্তরও বিষাক্ত হওয়ার জোর আশঙ্কা রয়েছে। 

একই বিষয়ে সংসদ সদস্য এস এম আল মামুন প্রথম আলোকে বলেন, নির্বাচিত স্থানের আশপাশে জনবসতি রয়েছে। এক পাশে ইকোপার্ক, আরেক পাশে চন্দ্রনাথ মন্দির। প্রতিবছর কয়েক লাখ তীর্থযাত্রী চন্দ্রনাথ মন্দিরে যাতায়াত করেন। পৌরসভার ভেতরে বর্জ্য শোধনাগার তৈরি হলে পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়বে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। তাই সীতাকুণ্ডের চরাঞ্চলে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করার পরামর্শ দিয়েছেন তিনিসহ অন্য জনপ্রতিনিধিরা।

‘পার্কের পাশে শোধনাগার তৈরির কোনো সুযোগ নেই’

ইকোপার্ক ও বোটানিক্যাল গার্ডেনের পাশে এ ধরনের বর্জ্য শোধনাগার নির্মাণের কোনো সুযোগ নেই বলে মনে করেন বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বর্জ্য শোধনাগার নির্মাণের জায়গা কোথায় হবে, কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিধিমালায় স্পষ্ট করে বলে দেওয়া হয়েছে। বোটানিক্যাল গার্ডেন, ইকোপার্ক কিংবা পাহাড়ের আশপাশে শোধনাগার নির্মাণের কোনো সুযোগ নেই। পরিবেশ মন্ত্রণালয় এ আইন তৈরি করেছে। ফলে পরিবেশের ছাড়পত্র পাওয়ারও সুযোগ নেই। আর এ শোধনাগার তৈরি হলে ওখানে দুর্গন্ধের সৃষ্টি হবে। বর্জ্য ভাঙতে শব্দ হবে। এতে পাখি ও বন্য প্রাণীর অসুবিধা হবে। বাতাস দূষিত হয়ে ছড়িয়ে পড়লে উদ্ভিদকুল ও মানুষের ক্ষতি হবে।