বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গে পাখি নিয়ে অনেক পাখিপুরাণ প্রচলিত। পশ্চিমবঙ্গের কোনো কোনো এলাকায় পানকৌড়ি নিয়ে তেমনই একটি পাখিপুরাণ আছে।
গল্পটা এ রকম:
পানকৌড়ি আগে ছিল এক গেরস্তঘরের বউ। তার গলাটা ছিল বেশ লম্বা, আর গায়ের রং অত্যন্ত কালো। রূপের ছিরি দেখে স্বামী তাকে ভালোবাসত না, শাশুড়িও নানা রকম অত্যাচার করত। বউটি মাছ খেতে অত্যন্ত ভালোবাসত, কিন্তু বাড়িতে মাছ রান্না হলেও শাশুড়ি তাকে দিত না। একদিন বাড়িতে অনেক মাছ রান্না হলো। কিন্তু প্রতিদিনের মতো সেদিনও শাশুড়ি তাকে মাছ খেতে দিল না।
অথচ বউটির ভারি ইচ্ছা হলো মাছ খেতে। কিন্তু মাছ খেতে না পেরে রাগে-দুঃখে সে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করল। ডুবে মরার পর সে হয়ে গেল একটি পানকৌড়ি। বউটি কালো ছিল, তাই পানকৌড়িও কালো। বউটির গলার মতোই পানকৌড়ির গলা লম্বা। শাশুড়ি মাছ খেতে দিত না বলেই পানকৌড়ি সাধ মিটিয়ে কেবল মাছই খায়। বউটি পানিতে ডুবে মরার পরই শাশুড়ির অত্যন্ত অনুতাপ হয়। তাই শাশুড়ি তাকে বারবার পানি থেকে উঠে আসতে বলে।
এটি নিয়ে ছড়াও রয়েছে:
পানকৌড়ি পানকৌড়ি ডাঙায় ওঠো না,
তোমার শাশুড়ি বলে গেছে বেগুন কেটো না।
পানকৌড়ি নিয়ে যে পাখিপুরাণ বর্ণিত হলো, তা আমাদের লোকসাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে, সন্দেহ নেই। পানকৌড়ি জলকাম বা ফ্যালাক্রোকোরাসিডি গোত্রের পাখি। মাঝারি থেকে বড় আকারের জলচর পাখিগুলোর দেহ কিছুটা লম্বাটে। গলা লম্বা, ঠোঁট শক্ত ও বাঁকা, লেজ শক্ত। পায়ের পাতা বড় ও আঙুলগুলো পর্দা দিয়ে যুক্ত। তাই ওরা বেশ ভালো সাঁতার কাটতে পারে। পানির নিচ থেকে চমৎকারভাবে মাছ শিকার করে।
বিশ্বব্যাপী ৩৫ প্রজাতির পানকৌড়ির অস্তিত্ব থাকলেও এ দেশে রয়েছে মোটে ৩টি। এদের মধ্যে পানকৌড়ি ও মাঝারি পানকৌড়ি আবাসিক এবং বৃহৎ পানকৌড়ি শীতের পরিযায়ী।
মরা নদী, খাল বা বিলে দাঁড়িয়ে থাকা গাছের ডাল, পোঁতা বাঁশ বা খুঁটিতে যে পাখিটিকে সবচেয়ে বেশি দেখা যায়, সেটি হলো এ দেশের বহুল দৃশ্যমান আবাসিক পাখি পানকৌড়ি। পানিকাউর, পানিকাক বা ছোট পানকৌড়ি নামেও এটি পরিচিত। ইংরেজি নাম লিটল করমোরেন্ট। বৈজ্ঞানিক নাম Phalacrocorax niger। বাংলাদেশ ছাড়াও এশিয়ার বহু দেশেই দেখা মেলে। ওজন ৩৬০ থেকে ৫২০ গ্রাম। সবুজ চোখের এ পাখির আয়ু ৮ থেকে ৯ বছর।
বড় আকারের (দৈর্ঘ্য ৭৭ থেকে ৯০ সেমি) যে পানকৌড়িকে শীতে দেখা যায়, সেটি বিশ্বের বৃহত্তম এবং এ দেশের সচরাচর দৃশ্যমান পরিযায়ী পাখি বৃহৎ পানকৌড়ি। বড় পানকৌড়ি বা গয়েল নামেও এটি পরিচিত। ইংরেজি নাম গ্রেট বা ওরিয়েন্টাল করমোরেন্ট। বৈজ্ঞানিক নাম Phalacrocorax carbo। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া মহাদেশ ছাড়াও চীন, জাপান, ইন্দোনেশিয়াসহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে মূল আবাস। ওজন ২.৬ থেকে ৩.৭ কেজি। এ পাখির চোখ সবুজ। আয়ু ১১ থেকে ১২ বছর।
এ দেশের তৃতীয় ও সর্বশেষ প্রজাতির পানকৌড়িটির নাম মাঝারি পানকৌড়ি। এটিকে শুধু রাজশাহী বিভাগে, বিশেষ করে চাঁপাইনবাবগঞ্জের রহনপুরে দেখা যায়।
নীল চোখের এবং প্রায় ৬৩ সেন্টিমিটার দৈর্ঘ্যের মাঝারি পানকৌড়িটি এ দেশের বিরল আবাসিক পাখি। পশ্চিমবঙ্গে জলকাক নামে পরিচিত। ইংরেজি নাম ইন্ডিয়ান করমোরেন্ট বা ইন্ডিয়ান শ্যাগ। বৈজ্ঞানিক নাম Phalacrocorax fuscicollis। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারতীয় উপমহাদেশসহ থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত পাখিটির ওজন ৬০০ থেকে ৭৯০ গ্রাম। আয়ুষ্কাল ৮-৯ বছর।
তিন প্রজাতির পানকৌড়িই দেশজুড়ে বিভিন্ন হাওর, বিল, নদী, মোহনা, খাল, উপকূল, পুকুর, হ্রদ, জলাভূমি ইত্যাদিতে একাকী, জোড়ায় বা দলে বিচরণ করে। পানিতে ডুব দিয়ে ও সাঁতার কেটে মাছ, ব্যাঙ ও চিংড়িজাতীয় প্রাণী শিকার করে খায়।
পানি থেকে উঠে বিশেষ ভঙ্গিতে ডানা ও লেজ মেলে ধরে শুকনা জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, এ রকম ভঙ্গিমা ওদের খাবার হজমে সাহায্য করে। সচরাচর নীরব হলেও প্রজননকালে ওরা ঠোঁট দিয়ে খটখট শব্দ করে।
ছোট ও বড় পানকৌড়ি এপ্রিল থেকে জুলাইয়ে প্রজনন করলেও মাঝারি পানকৌড়ির প্রজননকাল জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি। এরা পানির ধারে বড় গাছের শাখায় দল বেঁধে কলোনি তৈরি করে শুকনা সরু ডালপালা, জলজ উদ্ভিদ, লতাপাতা, শিকড় ইত্যাদি দিয়ে পাতিকাকের মতো বাসা বানায়।
ছোট পানকৌড়ি ২ থেকে ৬টি সাদা রঙের ডিম পাড়ে, যা ১৫ থেকে ২১ দিনে ফোটে। বড় পানকৌড়ি ৩ থেকে ৫টি সবুজাভ-নীল ডিম পাড়ে, যা ফোটে ২৮ থেকে ৩১ দিনে। অন্যদিকে মাঝারি পানকৌড়ি ৩ থেকে ৬টি নীলাভ-সবুজ ডিম পাড়ে।
আ ন ম আমিনুর রহমান, পাখি ও বন্য প্রাণী চিকিৎসাবিশেষজ্ঞ