ড্রিম ভিলেজ পার্কের দুই উদ্ভিদ

ডাবুরের আদি নিবাস ভারত ও দক্ষিণ এশিয়া। এটি উপকূলীয় লবণাক্ত জলাবন এবং জলাভূমিতে দারুণভাবে বৃদ্ধি পায়। এই উদ্ভিদ শক্তিশালী বিষ উৎপন্ন করে, যা খেলে মানুষ মারা যায়।

ময়মনসিংহের বৈলরের ড্রিম ভিলেজ পার্কের ডাবুরগাছছবি: লেখক

জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি গিয়েছিলাম ময়মনসিংহের বৈলরের ড্রিম ভিলেজ পার্কে। প্রকৃতিতে তখন শীতের আমেজ। পার্কে বড় এক মাঠের ধারে পাশাপাশি দুটি কটেজ। কটেজের পেছনে লেক, লেকের ধারে পাকা রাস্তা। এই রাস্তায় হাঁটতে বেরিয়ে ছোট গুল্মজাতীয় উদ্ভিদ চোখে পড়ল। ওখানে রাস্তার পাশে, পুকুরের ধারে বেশ কিছু লাল ঠোঁট গাছ চোখে পড়ল। ঝোপালো এই গাছকে ছাঁটাই করে সুন্দর বল বা ব্যাঙের ছাতার আকৃতি দেওয়া হয়েছে। দেখতে গুলাচি বা কাঠগোলাপের মতো। ভালো করে দেখে বুঝলাম এটি ডাবুর। এ ছাড়া ওখানে রাস্তার পাশে, পুকুরের ধারে বেশ কিছু লাল ঠোঁট গাছ চোখে পড়ল।

ডাবুর

ঝোপালো ডাবুরগাছকে ছাঁটাই করে সুন্দর বল বা ব্যাঙের ছাতার আকৃতি দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ডাবুরের গাঢ় সবুজ, বেগুনি বা লাল পাতা দেখতে গুলাচির পাতার মতো, গাছের আকৃতিও ও রকম। ফুল আকর্ষণীয় গোলাপি এবং সাদা হালকা সুগন্ধি। ডাবুর সুনিষ্কাশিত, কম্পোস্টযুক্ত মাটি পছন্দ করে। আংশিক আলো–ছায়াপূর্ণ রোদ এদের পছন্দ। এরা তুষারপাত এবং খরা সহনশীল।

উদ্ভিদের ভ্যারাইটির নাম Cerbera odollam rubra, এটি Apocynaceae পরিবারের উদ্ভিদ। করবী আর ডাবুর একই পরিবারের সদস্য। এটি ইংরেজিতে সুইসাইড ট্রি, গ্রে মিল্কউড, জঙ্গলি আম, পং পং, সামুদ্রিক আম, হলুদ-চোখের সারবেরা ইত্যাদি নামে পরিচিত। রাস্তার দুপাশে, পুকুর, লেকের ধারে এই উদ্ভিদের ঝোপ খুব সুন্দর মানায়।

ডাবুরের আদি নিবাস ভারত ও দক্ষিণ এশিয়া। এটি উপকূলীয় লবণাক্ত জলাবন এবং জলাভূমিতে দারুণভাবে বৃদ্ধি পায়। এই উদ্ভিদ শক্তিশালী বিষ উৎপন্ন করে, যা খেলে মানুষ মারা যায়। ডাবুরের ফুল সাদা, উজ্জ্বল, তারকা আকৃতির, ৫-৭ সেন্টিমিটার দৈর্ঘ্যের, ফুলের একটি ছোট হলুদ কেন্দ্র থাকে। পাতাগুলো ১২-৩০ সেন্টিমিটার লম্বা, ডিম্বাকৃতি, গাঢ় সবুজ এবং চকচকে। পাতা শাখার আগায় ঘন সর্পিলাকারে আটকে থাকে। ফল যখন সবুজ থাকে, তখন ছোট আমের মতো দেখায়। ফলের ভেতরে সাদা শাঁস থাকে। এই শাঁস বাতাসের সংস্পর্শে এলে বেগুনি, তারপর গাঢ় ধূসর এবং শেষ পর্যন্ত বাদামি বা কালো হয়ে যায়। গাছ থেকে সাদা রঙের ল্যাটেক্স বা তরুক্ষীর বের হয়, যা খুব বিষাক্ত।

বৈলরের ড্রিম ভিলেজ পার্কের লাল ঠোঁট গাছ
ছবি: লেখক

লাল ঠোঁট

লাল ঠোঁট চিরসবুজ ঝোপ বা গুল্মজাতীয় উদ্ভিদ। কচি পাতা প্রথমে লাল থাকে এবং শেষে সবুজ হয়ে যায়। প্রশাখার অগ্রভাগে লাল পাতাগুলো থাকে, দেখতে যেন সবুজ টিয়া পাখির লাল ঠোঁট। এ জন্যই হয়তো ইংরেজিতে এই উদ্ভিদকে রেড লিপ এবং বাংলায় লাল ঠোঁট বলা হয়। এর বৈজ্ঞানিক নাম Syzygium myrtifolium, এটি Myrtaceae পরিবারের উদ্ভিদ। উদ্ভিদটি ডালপালাসহ ২০ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়।

এর পত্রবিন্যাস বিপরীত, পাতা উপবৃত্তাকার থেকে ল্যান্স আকৃতির, বোঁটাযুক্ত, প্রায় ৭.৫ সেন্টিমিটার লম্বা এবং ২.৫ সেন্টিমিটার চওড়া। কচি পাতা প্রথমে লালচে হয়ে ওঠে, পরে লাল-বাদামি, তারপর সবুজ হয়ে যায়। পুষ্পমঞ্জরি শাখান্বিত, ৪ সেন্টিমিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। ফুল ক্রিম থেকে সাদা রঙের হয়। ফল গোলাকার থেকে উপবৃত্তাকার, রসাল ও মাংসল। ফলগুলো গাঢ় লাল থেকে লালচে বেগুনি রঙের, পুরোটা পাকলে কালো হয়ে যায়। ফল প্রায় ৯ মিলিমিটার চওড়া।

এই উদ্ভিদ নিম্নভূমির বনে, উপকূলীয় বনে, মিঠাপানির জলাভূমির কাছাকাছি এবং নদীর তীরে জন্মে। রেড লিপ উদ্ভিদের আদি নিবাস বাংলাদেশ, মালয়েশিয়া। দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ায় আলংকারিক উদ্ভিদ হিসেবে লাগানো হয়। বাগানের উদ্ভিদ হিসেবে, সাধারণত বেড়া হিসেবে লাগানো হয়। পুকুর, সড়ক বা লেকের ধারে লাগালে খুব ভালো দেখায়। এই গাছ দ্রুত বৃদ্ধি পায়। ছাঁটাই করে রাখলে ভালো দেখায়। সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো এই উদ্ভিদকে ছেঁটে বিভিন্ন আকৃতি দেওয়া যায়।

চয়ন বিকাশ ভদ্র, অধ্যাপক, উদ্ভিদবিজ্ঞান ও প্রকৃতিবিষয়ক লেখক