দুর্লভ বাদুড় ফুলের কথা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বোটানিক্যাল গার্ডেনে ফুটেছে বাদুড় ফুল বা মাতিমুন্দা। সম্প্রতি তোলাছবি: লেখক

পৃথিবীজুড়ে কালো রঙের ফুলের সংখ্যা কমই বলা যায়। উদ্ভিদচর্চার ২৫ বছরেও কালো রঙের ফুল খুব একটা চোখে পড়েনি। যে ফুলের কথা বলছি, সেটি শুধু কালোই নয়, গড়নের দিক থেকেও কিছুটা অদ্ভুত রকমের। দেখতে অনেকটা বাদুড়ের মতো। এ কারণে এর ইংরেজি নাম ‘ব্যাট ফ্লাওয়ার’ বা বাদুড় ফুল। প্রথম ১৯০১ সালে বিজ্ঞানী অ্যাডওয়ার্ড অ্যানড্রিই এই ফুল শনাক্ত করে বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। স্বপরাগায়ন–পদ্ধতির জন্যও ফুলটি বিখ্যাত।

২০০৪ সালের দিকে অদ্ভুতদর্শন এই ফুল প্রথম দেখি বাংলাদেশ শিশু একাডেমির বাগানে। টবে লাগানো গাছটি সংগ্রহ করেছিলেন তত্কালীন পরিচালক প্রকৃতিপ্রেমী ফিরোজ সালাহ্ উদ্দিন। উদ্ভিদবিদ্যায় পড়াশোনার কারণে উদ্ভিদের প্রতি তাঁর মমত্ববোধ ছিল প্রবল। কয়েক বছর আগে ফুলটি আবার দেখি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের বোটানিক্যাল গার্ডেনে। ফুলের অনুজ্জ্বল রং পাতা ও কাণ্ডের সঙ্গে চমত্কারভাবে মিশে থাকে।

এ কারণে ভালোভাবে লক্ষ্য না করলে এটি চোখে পড়ে না। বৃহত্তর সিলেটে প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো এই ফুলের নাম মাতিমুন্দা। কোথাও কোথাও হাইকান্দ বা সুকারকান্দা নামেও পরিচিত। উদ্ভিদবিজ্ঞানের আকরগ্রন্থেও এই তথ্য নিশ্চিত করা হয়েছে। তা ছাড়া আইইউসিএন পরিচালিত একটি মাঠপর্যায়ের গবেষণায় বলা হয়েছে, হবিগঞ্জের রেমা কালেঙ্গা বনে সাদা রঙের বাদুড় ফুলও রয়েছে।

বাদুড় ফুল বা মাতিমুন্দা (Tacca chantrieri) বহুবর্ষজীবী বীরুৎশ্রেণির উদ্ভিদ, স্থানভেদে গাছটির উচ্চতা ৭০ থেকে ১০০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত হতে পারে। পাতা আয়তকার, চকচকে সবুজ। পুষ্পমঞ্জরি ১ থেকে ২টি, প্রতিটি সাধারণত ৪টি থেকে ৬টি ফুল সংবলিত, বিরল ক্ষেত্রে ২৫টি পর্যন্ত থাকতে পারে। খাড়া পুষ্পদণ্ড ৭০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। মঞ্জরিপত্র ৪টি, সবুজাভ বা রক্ত-বেগুনি প্রতিটি ফুল মঞ্জরিপত্রের কক্ষে জন্মে। পুষ্পবৃন্তক সবুজাভ থেকে গাঢ় রক্ত-বেগুনি। ওপরের দুটি লম্বাটে, চ্যাপ্টা, নিচের একটি ছোট। মঞ্জরিপত্রাবরণ ৪টি, ২টি তির্যক জোড়ায় বিন্যস্ত, সবুজ থেকে গাঢ় রক্ত-বেগুনি, অবৃন্তক, পাপড়ির কেন্দ্র থেকে বেরোয় এক থোকা সরু আঁশ, সর্বোচ্চ ৩০ সেন্টিমিটার লম্বা। পুংকেশর ৬টি এবং গর্ভপত্র ৩টি। ফুল ফোটার মূল মৌসুম বসন্ত থেকে হেমন্ত অবধি বিস্তৃত।

গাছের কাণ্ড চর্মরোগে ব্যবহার্য। ভিয়েতনামে গ্রন্থিকন্দ অ্যালকোহলে ভিজিয়ে নরম করা হয় এবং বাহ্যিকভাবে বাতরোগ নিরাময়ে প্রয়োগ করা হয়। থাইল্যান্ডে গ্রন্থিকন্দ জ্বরনাশক হিসেবে ব্যবহার করা হয়। কোথাও কোথাও গাছের কচিপাতা এবং পুষ্পমঞ্জরি সবজি হিসেবে খাওয়ার প্রচলন রয়েছে। চীনে লোকচিকিত্সায় এই গাছের মোথাকন্দ নানাভাবে ব্যবহৃত হয়। বিশেষ করে উচ্চ রক্তচাপ, গ্যাস্ট্রিক আলসার, পোড়া, হেপাটাইটিস এবং এন্টারাইটিস রোগের চিকিত্সায় অনেক আগে থেকেই এ গাছ ব্যবহার করা হয়।

হিমালয়ের পাদদেশে এ গাছের বিস্তার লক্ষ্য করা যায়। তা ছাড়া দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো যেমন ভারত, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, চীন ও মালয় দ্বীপাঞ্চলে গাছটি সহজলভ্য। সাধারণত সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এক হাজার মিটার উচ্চতা পর্যন্ত চিরহরিৎ অরণ্যে গাছটি স্বাভাবিকভাবেই জন্মে। বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি প্রকাশিত বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষ গ্রন্থে গাছটিকে দুর্লভ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। পাশাপাশি গাছটির বর্তমান পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে সংরক্ষণের সুপারিশও করা হয়েছে।

  • মোকারম হোসেন, প্রকৃতি ও পরিবেশবিষয়ক লেখক