সংকটাপন্ন খ্যাঁকশিয়াল

শেরপুর শহরের কাছে গ্রামীণ পরিবেশে খ্যাঁকশিয়ালছবি: লেখক

কমবেশি ৪০ বছর আগের কথা। নিজ গ্রাম মুন্সিগঞ্জের গজারিয়ার বাউশিয়ায় বেড়াতে গেলে কবরস্থানের আশপাশে মাঝেমধ্যে ওদের দেখতাম। রাতে ওদের ‘ফেউ-ফেউ’ ডাকে ভয়ে বিছানায় গুটিসুটি মেরে শুয়ে থাকতাম। প্রায়ই সকালে ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইওয়েতে গাড়িচাপায় মৃত প্রাণীগুলোর নিথর দেহ পড়ে থাকতে দেখা যেত। হাঁস–মুরগি চুরির কারণে গ্রামের মানুষ ওদের অপছন্দ করত। তবে চুরির অপরাধে যতটা না মারা পড়ত, তার চেয়েও বেশি মরত রাতে গাড়িচাপায়। সেই কম বয়সে পরিবেশে ওদের গুরুত্ব না বুঝলেও মৃত প্রাণীগুলো দেখে মনটা খারাপ হয়ে যেত।

গ্রামে ওদের দেখা যায় না বহু বছর। দ্রুত নগরায়ণের ফলে বদলে গেছে গ্রামের চেহারা। হাইওয়ের পাশের জমিসহ অন্যান্য জমিতে বড় বড় শিল্পকারখানা, দোকানপাট ও বাড়িঘর হয়েছে। গাছপালা-ঝোপঝাড় কমে গেছে ব্যাপকভাবে। যেখানে একসময় কবরস্থানে ছিল ওদের অবাধ বিচরণ, সেখানে আজ কবরস্থানের আশপাশে মানুষের অবাধ বিচরণ ও বসবাস। কাজেই প্রাণীগুলো থাকবে কোথায়? অতএব, ওরা হারিয়ে গেছে আমার গ্রাম থেকে।

মৌসুমভেদে দেহের রঙের তারতম্য হয়। সামনের পায়ে পাঁচটি ও পেছনের পায়ে চারটি করে আঙুল ও নখ থাকে।

এরপর বহুদিন দেশের বহু গ্রামে ওদের খুঁজেছি, কিন্তু দেখা পাইনি। কিন্তু ১ মার্চ ২০২৪-এ ওদের দেখার সুযোগ এসে গেল। সেদিন শেরপুর বার্ড ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মো. মুগনিউর রহমান মনি ভাইয়ের আমন্ত্রণে ওখানে গেলাম। পরদিন ঝিনাইগাতীর রাঙটিয়ায় পাখি-প্রজাপতি দেখে ৩ মার্চ সদর উপজেলার একটি গ্রামে প্রাণীটির খোঁজে বেরিয়ে পড়লাম। কিন্তু দুই ঘণ্টা ধরে খুঁজেও দেখা পেলাম না। খুঁজতে খুঁজতে একসময় বিশাল এক পুকুরের কাছে ওদের বাসার সন্ধান মিলল। সেখানে এক প্রবীণের সঙ্গে আলাপে জানতে পারলাম ওখানে সাত-আটটি প্রাণী রয়েছে। একটি বাসার মুখ দেখিয়ে বললেন, এর ভেতর চারটি ছানা আছে। উনি প্রাণীগুলোকে মারার অনেক চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছেন। এ কথা শুনেই মনটা খারাপ হয়ে গেল। আমি ও মনি ভাই ওনাকে পরিবেশে প্রাণীগুলোর গুরুত্ব বোঝালাম ও সংরক্ষণে উদ্বুদ্ধ করলাম।

ওখান থেকে ফিরে ওদের বিচরণক্ষেত্রে ঘাপটি মেরে বসে রইলাম। ১১টা ৩৮ মিনিটে মনি ভাইয়ের ইশারায় সামনে তাকালাম। সঙ্গে সঙ্গে ক্যামেরার শাটার ক্লিক ক্লিক শব্দে প্রাণীটিকে স্বাগত জানাল। মাত্র ১২ সেকেন্ড ছিল। আধঘণ্টা পর আবারও এল ১৪ সেকেন্ডের জন্য।

একসময় ওরা দেশব্যাপী বিস্তৃত ছিল, বিশেষত উপকূলীয় অঞ্চলে। কিন্তু নানা কারণে বর্তমানে দেশের পশ্চিম ও উত্তর–পশ্চিমাঞ্চলে সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে। অবশ্য উত্তর ও উত্তর–পূর্বাঞ্চলের কোনো কোনো স্থানেও কদাচ দেখা মেলে।

গল্পের এই প্রাণী এ দেশের দুর্লভ স্তন্যপায়ী প্রাণী খ্যাঁকশিয়াল (বেঙ্গল ফক্স)। খেকি বা বাড়াল নামেও পরিচিত। আমার গ্রামে বলে বাওরাল। ক্যানিডি গোত্রের প্রাণীটির বৈজ্ঞানিক নাম Vulpes bengalensis। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, পাকিস্তান ও নেপালে দেখা যায়।

খ্যাঁকশিয়াল ছোট প্রাণী। দেহের দৈর্ঘ্য ৪৫ থেকে ৬০ সেন্টিমিটার, লেজ ২৫ থেকে ৩০ সেন্টিমিটার। উচ্চতা ২৬ থেকে ২৮ সেন্টিমিটার, ওজন তিন থেকে চার কেজি। মুখ লম্বাটে, মাথা ছোট ও সরু। নাকের আগায় ছোট্ট কালো নাকবন্ধনী। লম্বা চোখা কান। সাদা ফুটকিসহ দেহের ওপরটা লালচে-ধূসর ও নিচটা ফ্যাকাশে সাদা। ধূসর ঝোপালো লেজের গোড়া লাল ও আগা কালো। পায়ের বাইরের অংশ উজ্জ্বল লালচে। মৌসুমভেদে দেহের রঙের তারতম্য হয়। সামনের পায়ে পাঁচটি ও পেছনের পায়ে চারটি করে আঙুল ও নখ থাকে।

একসময় ওরা দেশব্যাপী বিস্তৃত ছিল, বিশেষত উপকূলীয় অঞ্চলে। কিন্তু নানা কারণে বর্তমানে দেশের পশ্চিম ও উত্তর–পশ্চিমাঞ্চলে সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে। অবশ্য উত্তর ও উত্তর–পূর্বাঞ্চলের কোনো কোনো স্থানেও কদাচ দেখা মেলে। আধা শুকনো, সমতল থেকে উঁচু–নিচু ভূমি, পাহাড়ের পাদদেশ, খোলা প্রান্তর, ঝোপজঙ্গল, কবরস্থান, তৃণভূমি, চাষের জমি ইত্যাদিতে ওরা ছোট পারিবারিক দলে থাকে। মূলত নিশাচর, তবে দিনেও দেখা মেলে। খুবই চালাক, কুশলী ও বুদ্ধিমান প্রাণীটি আহত, মরা বা ঘুমিয়ে থাকার ভান করে পাখিদের নিজের কাছাকাছি এনে শিকার করে। ক্ষুদ্র স্তন্যপায়ী প্রাণী, নির্বিষ সাপ, সরীসৃপ, ব্যাঙ, পাখি, ডিম, কাঁকড়া, পোকামাকড় ইত্যাদি খায়। সুযোগ পেলে হাঁস-মুরগিও খায়। ফসলের ক্ষতিকারক পোকামাকড় ও অপকারী প্রাণী খেয়ে এসব নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। ময়লা ও মরা-পচা-গলা খেয়ে পরিবেশ সুস্থ ও পরিচ্ছন্ন রাখে। পাকা ও মিষ্টি ফল খেয়ে ফলের বীজ ছড়াতে ভূমিকা রাখে।

নভেম্বর থেকে এপিল প্রজননকাল। মাটি যখন নরম থাকে, তখন গর্ত খুঁড়ে দুর্ভেদ্য সুড়ঙ্গ বাসা বানায়। সুড়ঙ্গে ছয় থেকে আটটি মুখ থাকে বিভিন্ন দিকে, যার কয়েকটি বন্ধ করে রাখে। এখানে নিরাপদে বসবাস ও বিশ্রাম ছাড়াও বাচ্চা প্রসব ও লালন-পালন করে। স্ত্রী ৫০ থেকে ৫৩ দিন গর্ভধারণের পর একসঙ্গে দুই থেকে চারটি ছানা প্রসব করে। ছানারা ১৫ থেকে ২০ মাসে বয়ঃপ্রাপ্ত হয়। আয়ুষ্কাল ১০ থেকে ১২ বছর।

  • আ ন ম আমিনুর রহমান, পাখি, বন্য প্রাণী প্রজনন চিকিৎসাবিশেষজ্ঞ