ঘূর্ণিঝড় মোখা ছিল ব্যতিক্রম

ঝড়ের মধ্যে পাঁচ বছরের শিশুসন্তানকে আশ্রয়কেন্দ্রে যাচ্ছেন নাজমা খাতুন। গতকাল বেলা ১টায়। জালিয়াপাড়া, শাহপরীর দ্বীপ, টেকনাফ, কক্সবাজারছবি: সাজিদ হোসেন

গত দুই যুগে দেশে আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড়গুলোর মধ্যে শক্তির তুলনায় না হলেও চরিত্রের দিক থেকে ঘূর্ণিঝড় মোখা ছিল ব্যতিক্রম। কেননা, দেশে এর আগে সিডর, আইলা বা ইয়াসের মতো শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়গুলো আঘাত হানার সময় উপকূলে তীব্র বাতাস, জলোচ্ছ্বাস ও বৃষ্টি একই সঙ্গে ছিল। কিন্তু গতকাল রোববার দুপুরে মোখা যখন উপকূলে আঘাত করেছিল, দেশের উত্তরাঞ্চল ও মধ্যাঞ্চলে রীতিমতো তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছিল। শুধু বাংলাদেশেই নয়, ভারত থেকে শুরু করে পূর্ব এশিয়াজুড়ে ওই তাপপ্রবাহ ছিল।

বাংলাদেশের ভূখণ্ডে অবস্থানের সময়ের দিক থেকেও ঘূর্ণিঝড়টি ব্যতিক্রম ছিল। আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত ২২ বছরের মধ্যে যে কটি ঘূর্ণিঝড় বাংলাদেশে আঘাত করেছে তার মধ্যে মোখা সবচেয়ে কম সময় ভূখণ্ডে অবস্থান করে। ঝড়টি বাংলাদেশের উপকূল দিয়ে যাওয়ার সময় ছিল মাত্র ৬ ঘণ্টা। ঝড়টির কেন্দ্র মূলত মিয়ানমারে আঘাত করে। এর অংশ বিশেষ সেন্ট মার্টিনের ওপর দিয়ে যায়। সেন্ট মার্টিনে এটার প্রভাব শুরু হয় দুপুর ১২টায়। আর সন্ধ্যা ৬টায় বাংলাদেশের উপকূল অতিক্রম করে যায়। অন্যদিকে ১৯৯১ সালে ২৯ এপ্রিল আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড়টি ১৮ ঘণ্টা বাংলাদেশের ভূখণ্ডে ছিল। ২০০৭ সালে ঘূর্ণিঝড় সিডর ছিল ১৬ ঘণ্টা, ২০০৯ সালে আইলা ছিল ৩০ ঘণ্টা, ২০২১ সালে ঘূর্ণিঝড় ছিল ২৮ ঘণ্টা। আর ২০২২ সালে ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাব ছিল ১০ ঘণ্টা।

আমরা শনিবার সকালেই বুঝতে পেরেছিলাম ঘূর্ণিঝড়টি নানা ধরনের প্রভাবে দ্রুত দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। সে অনুযায়ী আমরা পূর্বাভাস দিয়েছি। তবে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও গবেষকেরা হালনাগাদ পরিস্থিতি বিবেচনা না করেই অতিরঞ্জিত পূর্বাভাস দিয়েছেন
আবহাওয়াবিদ বজলুর রশিদ
আরও পড়ুন

গত শুক্রবার রাত থেকে পূর্বাভাসগুলোতে বলা হচ্ছিল, উপকূলে আঘাত হানার সময় প্রায় ২০০ কিলোমিটার গতি থাকতে পারে, ৮ থেকে ১২ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে ভেসে যেতে পারে উপকূল। দেশজুড়ে হতে পারে ভারী থেকে অতিভারী বৃষ্টি। দেশ-বিদেশের আবহাওয়াবিষয়ক সংস্থা ও আবহাওয়া গবেষকদের এমন সব পূর্বাভাসের পুরোটা শেষ পর্যন্ত সত্য প্রমাণিত হয়নি। বাংলাদেশের সেন্ট মার্টিন দ্বীপ ও টেকনাফে ঝোড়ো হাওয়া বয়ে গেলেও অন্যান্য এলাকায় খুব একটা প্রভাব পড়েনি। জলোচ্ছ্বাসের শঙ্কাও কেটে গেছে।

আরও পড়ুন

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ বজলুর রশিদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা শনিবার সকালেই বুঝতে পেরেছিলাম ঘূর্ণিঝড়টি নানা ধরনের প্রভাবে দ্রুত দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। সে অনুযায়ী আমরা পূর্বাভাস দিয়েছি। তবে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও গবেষকেরা হালনাগাদ পরিস্থিতি বিবেচনা না করেই অতিরঞ্জিত পূর্বাভাস দিয়েছেন।’

বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের যে অঞ্চল দিয়ে ঘূর্ণিঝড়টি আঘাত করে, দুই পাশেই পাহাড় ছিল। ফলে ওই মেঘমালা আর বেশি দূর ছড়াতে পারেনি। সে কারণে অন্য ঝড়গুলোর সময় যেমন প্রচুর মেঘ থাকে ও বৃষ্টি হয়, এই ঝড়ের ক্ষেত্রে তা হয়নি।

আবহাওয়াবিদেরা বলেছেন, ঘূর্ণিঝড়টি বাংলাদেশ ও মিয়ানমার উপকূলে ২০০ কিলোমিটারের মধ্যে আসার সময় এর বিস্তৃতিও কমে আসে। কেন্দ্রও ছোট হয়ে যায়। ফলে এর বাতাসের গতিবেগ কমে আসে। দেশের উপকূল থেকে বঙ্গোপসাগরে ৭০০ কিলোমিটার দূরে থাকার সময় ঘূর্ণিঝড়টির বিস্তৃতি ছিল প্রায় ৭০০ বর্গকিলোমিটার। কিন্তু উপকূলের ১০০ কিলোমিটারের মধ্যে এসে তা ৩০০ বর্গকিলোমিটারে নেমে আসে। একইভাবে কেন্দ্রও ছোট হয়ে আসে। ফলে উপকূলে আঘাত করার পরপরই এটি দুর্বল হয়ে যায়।

আরও পড়ুন

পূর্বাভাস অনুযায়ী ঘূর্ণিঝড় মোখার প্রভাবে বৃষ্টি না হওয়ার কারণ ব্যাখ্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবহাওয়া বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক তৌহিদা রশিদ বলেন, ঘূর্ণিঝড়টির চারপাশজুড়ে বায়ুমণ্ডলে অতিরিক্ত তাপের চাপ ছিল। ফলে এটি উপকূলে আঘাত হানার সময় এর চারপাশের জলীয়বাষ্প বা মেঘগুলো এক জায়গায় জড়ো হতে থাকে। একপর্যায়ে তা দেশের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ার বদলে ওপরের দিকে উঠে যায়।

ঘূর্ণিঝড় মোখার তাণ্ডবে বিধ্বস্ত ঘরবাড়ি। রোববার বিকেলে সেন্ট মার্টিন ইউনিয়নে
ছবি: সংগৃহীত

আবার ঘূর্ণিঝড়ের সঙ্গে আসা মেঘ চারপাশের উষ্ণ বাতাসের চাপে এক জায়গায় কেন্দ্রীভূত হওয়ায় সাগর থেকে যথেষ্ট পরিমাণে জলীয়বাষ্প টেনে নিতে পারেনি। আর ভূখণ্ডে ওঠার পর সেটি পাহাড়ে বাধা পায়। কারণ, বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের যে অঞ্চল দিয়ে ঘূর্ণিঝড়টি আঘাত করে, দুই পাশেই পাহাড় ছিল। ফলে ওই মেঘমালা আর বেশি দূর ছড়াতে পারেনি। সে কারণে অন্য ঝড়গুলোর সময় যেমন প্রচুর মেঘ থাকে ও বৃষ্টি হয়, এই ঝড়ের ক্ষেত্রে তা হয়নি।

আর ঘূর্ণিঝড়টি উপকূলে আঘাত হানার সময় সাগরে ভাটা চলছিল। ফলে জলোচ্ছ্বাসও কম হয়েছে।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ঘূর্ণিঝড় মোখা আঘাত করার সময় রংপুর ও রাজশাহী বিভাগ, টাঙ্গাইল, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা ও নেত্রকোনার ওপর দিয়ে তাপপ্রবাহ বয়ে গেছে। সবচেয়ে বেশি তাপমাত্রা ছিল চুয়াডাঙ্গায়—৩৮ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর ঢাকার তাপমাত্রাও তাপপ্রবাহের কাছাকাছি, ৩৫ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এই ঝড়ের প্রভাবে দেশে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি হয়েছে টেকনাফে, ২২ মিলিমিটার। ঘূর্ণিঝড়ের সময় সবচেয়ে বেশি বাতাস ছিল বেলা আড়াইটায় সেন্ট মার্টিনে, ঘণ্টায় ১৪৭ কিলোমিটার।

সমুদ্রবিষয়ক গবেষণা সংস্থা ন্যাশনাল ওশানোগ্রাফিক অ্যান্ড মেরিটাইম ইনস্টিটিউটের (নোয়ামি) নির্বাহী পরিচালক মোহন কুমার দাশ প্রথম আলোকে বলেন, ঘূর্ণিঝড়টির ওপরে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়াজুড়ে চলা তাপপ্রবাহের প্রভাব ছিল। সে কারণে বাতাসের গতি ও মেঘ কমে গেছে। আর ভাটার সময় আঘাত হানার কারণে জলোচ্ছ্বাসও কম ছিল। এই ঝড় নিয়ে অবশ্যই আরও গবেষণা করা উচিত। দেশের ভবিষ্যৎ ঘূর্ণিঝড়গুলোর পূর্বাভাস দেওয়ার ক্ষেত্রে এই ঝড়ের অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে হবে।