বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেটেরিনারি মেডিসিন (প্রাণী চিকিৎসা) অনুষদের চতুর্থ বর্ষের ছাত্রছাত্রীদের ১০ দিনব্যাপী শিক্ষাসফর শেষ করে মাত্র বাসায় ফিরেছি। কিন্তু এরই মধ্যে ফেসবুকের বদৌলতে জানতে পেরেছি, ঢাকার আফতাবনগর লেকের পাড়ে ঘাস ও নলখাগড়ার বনে অতি সুন্দর তিনটি পরিযায়ী পাখির আগমন ঘটেছে। ছোট্ট এই পাখিগুলোর গলায় রয়েছে টকটকে লাল বা নীলের খেলা। তবে ১০ দিনের সফরে অত্যন্ত ক্লান্ত থাকায় সেদিন আর ওদিকে গেলাম না।
পরদিন খুব ভোরে পাখি দেখার নিত্যসঙ্গী ভাগনে জাহিনুল ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে আফতাবনগর গেলাম। পক্ষী আলোকচিত্রী ইমরুল হাসানের নির্দেশিত জায়গায় পৌঁছাতে তেমন একটা কষ্ট হলো না। কিন্তু ওখানে গিয়েই টের পেলাম বেশ দেরি করে ফেলেছি। কারণ, নলখাগড়ার ঝোপের সামনে এরই মধ্যে এক ডজনের বেশি আলোকচিত্রী ক্যামেরা তাক করে দাঁড়িয়ে আছেন। আমরা যাওয়ার পর আরও কয়েকজন যোগ দিলেন।
নলখাগড়ার ঝোপে যে পাখিগুলোর সন্ধানে এসেছি, ওদের কোনো চিহ্নই দেখছি না। অথচ কদিন ধরে প্রচুর আলোকচিত্রী ওদের ছবি তুলেছেন। তিন প্রজাতির মধ্যে দুটিকে দেশের বিভিন্ন স্থানে বহুবার দেখলেও বাকিটি বেশ বিরল। মৌলভীবাজারের কুরমা পক্ষী অভয়াশ্রমে ওকে দেখেছি ২০২২ সালের নভেম্বরে। বাকি দুটির একটিকে ২০২৩-এর জানুয়ারিতে আফতাবনগরেই দেখেছি। আর নীলগলারটিকে দেখলাম কিছুক্ষণ আগে। মুঠোফোনে বেশ কয়েকবার বিরল পাখিটির রেকর্ড করা ডাক বাজালে একঝলকের জন্য পাখিটি এসেছিল বটে। কিন্তু কেউ ওর ছবি তুলতে পারেননি। কাজেই বিফল মনোরথ হয়ে একে একে সবাই ফেরত গেলেন।
এই তিনটিসহ প্রায় একই রকমের চার প্রজাতির পাখি রয়েছে বিশ্বজুড়ে। এগুলো সাধারণভাবে গুম্পিগোরা বা গুপিগলা নামে পরিচিত। চার প্রজাতির মধ্যে দুটি এ দেশে নিয়মিত আসে, একটি আসে কালেভদ্রে আর অন্যটি একবারও আসেনি। এখানে ওদের পরিচয় অতি সংক্ষেপে তুলে ধরছি। মাসসিক্যাপিডি গোত্রের পাখিগুলোর স্ত্রী-পুরুষের গলার রঙে পার্থক্য থাকে। গলায় চুনি বা লাল এবং নীল রং শুধু পুরুষেই দেখা যায়।
১. গুপিগলা (সাইবেরিয়ান রুবিথ্রট): চুনি বা টকটকে লাল গলার দুর্লভ পরিযায়ী পাখিটি এ দেশে লালগলা, লালগলা ফিদ্দা বা গুম্পিগোরা নামে পরিচিত। আর পশ্চিমবঙ্গে বলে গুপিগলা বা গানগুলা। বৈজ্ঞানিক নাম Calliope calliope। মূল আবাস এলাকা সাইবেরিয়া হয়ে মঙ্গোলিয়া, জাপান ও কোরিয়ার উত্তরাঞ্চল এবং চীনের মধ্যাঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত। শীতে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ ও দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশ, তাইওয়ান ও ফিলিপাইনে পরিযায়ী হয়। দেহের দৈর্ঘ্য ১৪ থেকে ১৬ সেন্টিমিটার। ওজন ১৬ থেকে ২৯ গ্রাম।
২. চিনা গুপিগলা (চায়নিজ রুবিথ্রট): অতি বিরল এই পাখিকে মৌলভীবাজারের কুরমা পক্ষী অভয়াশ্রমে প্রথম দেখি ২০২২-এ। আফতাবনগরে একঝলকের জন্য দেখলেও ছবি তুলতে পারিনি। এটিকে চীনা লালগলাও বলা যায়। বৈজ্ঞানিক নাম Calliope tschebaiewi। মধ্য চীনের পাখিটি শীতে অনিয়মিতভাবে সিলেট বিভাগের ঝোপঝাড়ে পরিযায়ী হলেও এ বছরই প্রথম ঢাকায় এল। দৈর্ঘ্য ১৪ থেকে ১৫ সেন্টিমিটার। পাকিস্তান থেকে মিয়ানমার পর্যন্ত হিমালয়ান রেঞ্জ ও মধ্য চীনে পাখিটির দেখা মেলে।
৩. পাহাড়ি গুপিগলা বা লালগলা (হিমালয়ান রুবিথ্রট): এখন পর্যন্ত এটিকে বাংলাদেশে দেখা যায়নি। একসময় এটি ও চীনা লালগলা একটি প্রজাতি (হোয়াইট-টেইল্ড রুবিথ্রট) হিসেবে বিবেচিত হতো। কিন্তু বর্তমানে ওরা দুটি আলাদা প্রজাতি। বৈজ্ঞানিক নাম Calliope pectoralis। আফগানিস্তান থেকে মিয়ানমার পর্যন্ত হিমালয়ান রেঞ্জে প্রজাতিটির দেখা মেলে।
৪. নীলগলা বা নীলগলা ফিদ্দা (ব্লু থ্রট): অতি চঞ্চল পাখিটি এ দেশের দুর্লভ পরিযায়ী পাখি। পশ্চিমবঙ্গে নীলগ্রীব, গুপিকণ্ঠ, গুপিগোরা বা গুরপেওরা নামে পরিচিত। বৈজ্ঞানিক নাম Cyanecula svecica। পাখিটির মূল আবাস উত্তর ইউরোপ, ইউরেশিয়া, পশ্চিম আলাস্কা ও কানাডার ইয়াকন অঞ্চল। শীতে বাংলাদেশ ছাড়াও আফ্রিকা ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশে পরিযায়ী হয়। লম্বায় ১৩ থেকে ১৫ সেন্টিমিটার। ওজনে ১২ থেকে ২৫ গ্রাম।
আ ন ম আমিনুর রহমান: পাখি ও বন্য প্রাণী প্রজনন ও চিকিৎসাবিশেষজ্ঞ