মোংলায় সুপেয় পানির সংকট কমলো যেভাবে

বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার বসানো ট্যাপ থেকে গৃহস্থালির কাজের জন্য পানি সংগ্রহ করছেন স্থানীয় এক নারী। সম্প্রতি বাগেরহাটের মোংলার চিলা ইউনিয়নের বালুর মোড় এলাকায় তোলাছবি: প্রথম আলো

রেনুকা রায়ের যখন বিয়ে হয়, তখন তিনি কিশোরী। শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে দেখলেন ঘরের ধারেকাছে খাবার পানির ব্যবস্থা নেই। আধা ঘণ্টা পায়ে হেঁটে স্থানীয় ঘরামি পুকুর থেকে পানি আনা শুরু করলেন তিনি। সেই যে শুরু, এরপর থেকে ৩–৪ ঘণ্টা ব্যয় করে পানি সংগ্রহই হয়ে উঠলো তাঁর নিত্যদিনের কাজ।

রেনুকা রায় বলেন, ‘বড়লোকেরা তা–ও ভ্যানে বা নৌকায় করে পানি আনতেন। কখনো ঘরামি পুকুর, কখনো বিল পেরিয়ে কাইনবাড়ির পুকুর থেকে পানি আনতে বেশ সময় লাগত। পুকুরের পানিতে যে লবণ আছে তা–ও মোরা জানতাম না। ওই পানির জইন্যেই যে অসুখবিসুখ হয় সিডাও জানা ছিল না। উপায় তো নেই, ওই পানিই খাতাম। খাতি খাতি অভ্যাস হয়ে গেল।’

রেনুকা রায়ের বয়স এখন ৬০ পেরিয়েছে। ছেলের বিয়ের পর পুত্রবধূ বেশ কয়েক বছর ধরে পানি আনার কাজ করছেন। গত বছর বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাক ও ড্যানিস মিনিস্ট্রি অব ফরেন অ্যাফেয়ার্সের যৌথ উদ্যোগে রেনুকার বাড়িতে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের জন্য ফিল্টারসহ ট্যাংক স্থাপন করা হয়। রেনুকা বলেন, ‘এদ্দিনে একটা গতি হলো’।

রেনুকার বাড়ির মতো বাগেরহাটের মোংলা উপজেলার ছয়টি ইউনিয়নে চার হাজার ২০০টি পরিবারকে দুই হাজার লিটার ধারণক্ষমতাসম্পন্ন পানির ট্যাংকের ব্যবস্থা করেছে ব্র্যাক। সংস্থাটির তথ্য অনুযায়ী, মোংলার ২৪ হাজার মানুষ নিরাপদ খাবার পানির সুবিধার আওতায় এসেছে, যাদের মধ্যে ১১ হাজার ৫২০ জন নারী। ‘বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের মাধ্যমে নিরাপদ খাবার পানির নিরাপত্তা এবং জলবায়ু সহনশীলতা বৃদ্ধি’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় এ ব্যবস্থা করা হয়।

এখন পানি আনার জন্য বাড়ির বাইরে যেতে হয় না, পেটের অসুখও অনেক কমে গেছে বলে জানিয়েছেন ব্র্যাকের আরেক সুবিধাভোগী সবিতা বিশ্বাস। আগে যে সময় নিয়ে পানি আনতেন একই সময়ে তিনি এখন বাড়িতে হাঁস–মুরগী পালন, বাড়ির উঠানে সবজি বাগান, পুকুরে মাছের দেখাশোনা করতে পারেন।

ব্র্যাকের উদ্যোগে মোংলায় বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের জন্য পানির ট্যাংক বসানো হয়েছে। সম্প্রতি বাগেরহাটের মোংলার চাঁদপাই ইউনিয়নের মেছেরশাহ মাজার প্রাঙ্গণ থেকে তোলা
ছবি: প্রথম আলো

ব্র্যাক বলছে, আগে মোংলার মানুষকে সুপেয় পানি সংগ্রহ করতে ২-৩ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হতো। সময় ব্যয় হতো ৩-৪ ঘণ্টা। তবে লবণাক্ততার শিকার সবাইকে নিরাপদ পানির আওতায় এখনো আনা সম্ভব হয়নি বলে জানিয়েছেন মোংলার চিলা ইউনিয়নের সংরক্ষিত নারী আসনের সদস্য শিপ্রা হালদার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা আরও নানা উপায়ে চেষ্টা করে দেখেছি, কিন্তু খাবার পানি সংরক্ষণের জন্য ব্র্যাকের এই পদ্ধতি (বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ ব্যবস্থা) সবচেয়ে টেকসই।’

২০২২ সালের জনশুমারি ও গৃহগণনার তথ্য অনুযায়ী, মোংলার মোট জনসংখ্যা এক লাখ ৫৮ হাজার ৪৭০ জন। নারীর সংখ্যা ৭৮ হাজার ৩২৯। ব্র্যাক বলছে, উপজেলার মোট জনসংখ্যার ৬৭ হাজার ৩০০ জন মানুষ সরাসরি লবণাক্ততার শিকার। যার মধ্যে ৩২ হাজার ৪৮ জন নারী।

বিক্রি হয় পানি

বাগেরহাটের মোংলার মিঠাখালি ইউনিয়নের চৌরিডাঙ্গা আহমদিয়া দাখিল মাদ্রাসার পাশে বেশ জটলা দেখা গেল। এখানে মূলত পুকুরের পানি পাম্পের সাহায্যে তুলে বিশেষ পদ্ধতিতে শোধন করে খাওয়ার উপযোগী করা হয়। এই পদ্ধতির নাম ‘পন্ড স্যান্ড ফিল্টার’। ব্র্যাকের দুটি পন্ড স্যান্ড ফিল্টারের একটি এই মাদ্রাসার পাশে। স্থানীয়রা এখান থেকে খাবার পানি সংগ্রহ করছেন।

ব্র্যাকের পন্ড স্যান্ড ফিল্টারটি থেকে আর্থিক সক্ষমতার ভিত্তিতে পরিবারভেদে মাসে ৩০ থেকে ৫০ টাকার পানি বিক্রি করা হয়। এই ফিল্টারটি থেকে দৈনিক ২৫০টি পরিবার সেবা নিতে পারে।

এ ছাড়া ব্র্যাক ও ডেনমার্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে কমিউনিটিভিত্তিক বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা আছে ২৯টি। ২০ থেকে ৪০ হাজার লিটার ধারণক্ষমতাসম্পন্ন এসব ফিল্টার থেকে প্রতি লিটার পানি এক টাকায় বিক্রি করা হয়।

সংরক্ষিত বৃষ্টির পানি নিরাপদ রাখতে বাড়িতে বসানো ফিল্টার সংযোজন করে পরীক্ষা করা হচ্ছে। সম্প্রতি বাগেরহাটের মোংলার চিলা ইউনিয়নের বালুর মোড় এলাকায় তোলা
ছবি: প্রথম আলো

এমন একটি কমিউনিটিভিত্তিক পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা চিলা ইউনিয়নের সেতুবন্ধন সমবায় সমিতিতে স্থাপন করেছে ব্র্যাক। গত আগস্টে স্থাপিত এই ব্যবস্থার পানি ধারণ ক্ষমতা ৪০ হাজার লিটার। এখান থেকে প্রাথমিকভাবে ২৫টি পরিবারে পানি সরবরাহ করা হচ্ছে।

খাবার পানির সংকট কমেছে, গৃহস্থালির নয়

লবণাক্ত পানি ব্যবহারের কারণে চর্মরোগ হয়েছিল ১০ম শ্রেণির শিক্ষার্থী সুমাইয়া আক্তারের। চর্মরোগের দাগ এখনো মুখে রয়ে গেছে। মোংলার চাঁদপাই মেছেরশাহ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সুমাইয়া বলল, ‘লবণাক্ত পানি ব্যবহারের কারণে সবসময় অসুখবিসুখ লেগে থাকে। আমাদের অনেকের চুল পড়ে যাচ্ছে। গায়ের রং মলিন হয়ে যাচ্ছে। এজন্য আমার মন খারাপ থাকে।’

স্থানীয় লোকজন বলছেন, ১০–১৫ বছর আগেও অক্টোবরের মাঝামাঝি থেকে জুনের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত ভূ–উপরিস্থ পানিতে লবণের প্রভাব কম থাকত। এখন সেই সময় কমে ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকে এপ্রিল পর্যন্ত মাত্র পাঁচ মাস হয়েছে। ফলে বছরের সাত মাস লবণ পানি দিয়ে পয়ো–পরিস্কার ও গৃহস্থালির অন্যান্য কাজ করতে হয়।

মোংলা পৌরসভার নারিকেল তলা আবাসন প্রকল্পের বাসিন্দা রেকসোনা বেগম বলেন, ‘লবণ পানি ব্যবহারের কারণে সাবানে ফেনা হয় না। শরীর, কাপড় কোনোটাই পরিষ্কার হয় না।’ মাসিকের সময় লবণ পানি ব্যবহারের কারণে নারীদের জরায়ুর প্রদাহ হচ্ছে বলে জানান তিনি।

ব্র্যাকের কর্মকর্তা ও সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলছেন ব্র্যাকের বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ প্রকল্পের সুবিধাভোগীরা। সম্প্রতি বাগেরহাটের মোংলার চিলা ইউনিয়নের বালুর মোড় এলাকায় তোলা
ছবি: প্রথম আলো

গৃহস্থালি ও অন্যান্য কাজে ব্যবহারের জন্য পানির বিশেষ ব্যবস্থা করা প্রয়োজন বলে জানিয়েছেন চৌরিডাঙ্গা আহমাদিয়া দাখিল মাদ্রাসার সুপারিনটেন্ডেন্ট শেখ জালাল উদ্দিন। তিনি বলেন, গৃহস্থালির কাজে ব্যবহারের জন্য বন্ধু ফাউন্ডেশন নামের একটি সংস্থা পুকুরের পানি শোধন করে মাটির নিচে পাইপ ব্যবহার করে পাড়ায় পাড়ায় সরবরাহের ব্যবস্থা করেছে। একই পদ্ধতিতে পুরো মোংলায় পানির ব্যবস্থা করা গেলে সমস্যা কমে যাবে।

মোংলার অর্থনীতিতে বড় ভূমিকা রাখতো চিংড়ি চাষ। কিন্তু ইদানিং সাদা ভাইরাসের কারণে চিংড়ি চাষ মুখ থুবড়ে পড়েছে। তাই স্থানীয়রা আবার কৃষিকাজের দিকে ফিরতে চাচ্ছে।

তবে দীর্ঘদিন ধরে চিংড়িঘের তৈরির জন্য যে পরিমাণ লবণ জমির সঙ্গে মিশে গেছে তা দূর হতে ২৫–৩০ বছর সময় লাগবে বলে মন্তব্য করেছেন ব্র্যাকের জলবায়ু পরিবর্তন, নগর উন্নয়ন ও দুর্যোগ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা কর্মসূচির পরিচালক লিয়াকত আলী। তিনি বলেন, ‘পানির ব্যবস্থা আমরা করলাম। এরপর কৃষকদের সঙ্গে আলোচনা করে এবং গবেষণার সহায়তায় কৃষিকাজ আবার চালু করার ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করছি।’