জলবায়ু পরিবর্তনে ঝুঁকিতে খুলনা

‘জলবায়ু পরিবর্তন: উপকূলীয় অঞ্চলে এর প্রভাব ও প্রতিকারের উপায়’ শীর্ষক গোলটেবিল সংলাপে (বাঁ থেকে) গৌরাঙ্গ নন্দী, মো. নজরুল ইসলাম, আনোয়ারুল কাদির, মো. আবদুল করিম ও নবনীতা দত্ত। গতকাল খুলনা প্রেসক্লাবেছবি: প্রথম আলো

জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে উপকূলীয় দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চল ক্রমেই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে। লবণাক্ততা বৃদ্ধি, মিষ্টি পানির সংকট ও নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ নষ্ট হওয়ায় কৃষি, খাদ্যনিরাপত্তা ও মানুষের জীবিকা চাপে পড়েছে। একই সঙ্গে নারী ও শিশুর স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে, যা সামাজিক বৈষম্যকে আরও তীব্র করছে। জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতের পাশাপাশি মানবসৃষ্ট কর্মকাণ্ডে সুন্দরবনও চাপের মুখে পড়েছে। এই বাস্তবতায় খাতভিত্তিক বিচ্ছিন্ন উদ্যোগ নয়, বরং সমন্বিত ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার মাধ্যমেই টেকসই জলবায়ু অভিযোজন ও উন্নয়ন নিশ্চিত করা সম্ভব।

‘জলবায়ু পরিবর্তন: উপকূলীয় অঞ্চলে এর প্রভাব ও প্রতিকারের উপায়’ শীর্ষক বিভাগীয় সংলাপে এমন বক্তব্য উঠে এসেছে। হেলভেটাস বাংলাদেশের সহযোগিতায় উত্তরণ, ডর্প, ইএসডিও এবং প্রথম আলোর উদ্যোগে গতকাল রোববার খুলনা প্রেসক্লাবে এই সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়।

সংলাপে সরকারের বিভিন্ন অধিদপ্তর, নাগরিক সমাজ ও বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার প্রতিনিধি, ভুক্তভোগী নারী, পুরুষ, শিক্ষার্থী ও গণমাধ্যমকর্মী অংশ নেন।

সংলাপে সুন্দরবন একাডেমির নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক আনোয়ারুল কাদির বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত সবার ওপরই পড়ে। সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, দপ্তর ও অধিদপ্তর আলাদাভাবে কাজ করছে। ফলে উদ্যোগগুলো অনেক সময় টেকসই হচ্ছে না, কাঙ্ক্ষিত ফলও হয়তো আসছে না। আমরা যে ধরনের পরিকল্পনাই গ্রহণ করি না কেন, সেগুলো যদি সমন্বিত না হয়, তাহলে তা এসডিজির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে না, টেকসইও হবে না।’

আনোয়ারুল কাদির বলেন, ‘বিকল্প ফসল উৎপাদনের নানা কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু সেই খাদ্য আমাদের খাদ্যনিরাপত্তার সঙ্গে কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ, সেটি গভীরভাবে বিবেচনা করা প্রয়োজন। সুন্দরবনের জন্য আলাদা একটি মন্ত্রণালয় গঠনের বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে ভাবা দরকার।’

আলোচনায় অংশ নিয়ে খুলনার জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. আবদুল করিম বলেন, এখন ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রগুলো এমনভাবে তৈরি করা হচ্ছে, যেটা দুর্যোগের সময় মানুষ ও তাদের সম্পদকে শুধু নিরাপত্তা দিচ্ছে না, বরং অন্য সময় অন্য কাজে ব্যবহারের সুযোগও সৃষ্টি করছে। এখন আশ্রয়কেন্দ্রে বৃদ্ধ, নারী, বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষ—সবার জন্যই সুব্যবস্থা রাখা হচ্ছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর খুলনার উপপরিচালক মো. নজরুল ইসলাম বলেন, খুলনা বিভাগের ৯০ শতাংশ পানির উৎস হচ্ছে পদ্মা থেকে আসা গড়াই নদ। উজানে পানির প্রবাহ কমে যাওয়ার কারণে গড়াই নদসহ খুলনা বিভাগের শত শত নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ নষ্ট হয়েছে; অনেক নদী আজ কার্যত মৃতপ্রায়, যার সরাসরি প্রভাব পড়ছে কৃষি, জীববৈচিত্র্য ও মানুষের জীবিকায়। একই সঙ্গে এই অঞ্চলের খালগুলো ইজারা দেওয়ায় কৃষি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আন্তর্জাতিকভাবে পানি সমস্যার সমাধান করা, খালগুলো ইজারা দেওয়া বন্ধ করা এবং বিকল্প কৃষির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না পারলে এই অঞ্চলের কৃষি ও কৃষক আরও বড় হুমকির মুখে পড়বে।

মিষ্টিপানির আধার সৃষ্টি করতে হবে

লেখক ও গবেষক গৌরাঙ্গ নন্দী বলেন, খুলনা-বাগেরহাট-সাতক্ষীরা অঞ্চল একটি সংবেদনশীল ম্যানগ্রোভ ইকোলজির অংশ। এখানে মিষ্টি ও লবণ পানির মিশ্রণে গড়ে ওঠা একটি বিশেষ ভূপ্রাকৃতিক অঞ্চল রয়েছে, যা জিওলজিক্যালি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। এই অঞ্চলের ভূমি গঠনপ্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই বসতি স্থাপন ও নানা উন্নয়ন কর্মকাণ্ড শুরু হয়ে গেছে। ঐতিহ্যগতভাবে এ অঞ্চলের মানুষ পুকুরের পানি সংরক্ষণ করে পান করত। বর্তমান পানির সংকট মোকাবিলায় পুকুরকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে। একই সঙ্গে কৃষিকে টিকিয়ে রাখতে মিষ্টি পানির আধার সৃষ্টি ও সেগুলোর সংরক্ষণ নিশ্চিত করা জরুরি।

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) বিভাগীয় সমন্বয়কারী মাহফুজুর রহমান মুকুল বলেন, লবণ এবং মিষ্টিপানির মিশ্রণের এই অঞ্চলে লোনার পরিমাণ বেড়ে গেছে। সেটা সুন্দরবনকে ক্ষতির মুখে ফেলছে। এ ছাড়া প্লাস্টিক বর্জ্য দূষণ এবং অপরিকল্পিত ট্যুরিজম সুন্দরবনকে ক্ষতি করছে। বনকেন্দ্রিক প্রকল্পগুলো এমনভাবে নেওয়া উচিত, যা পরিবেশবান্ধব এবং মানুষের অংশগ্রহণের ভিত্তিতে হয়।

শিক্ষক ও নারীনেত্রী বেগম রেহানা ঈসা বলেন, উপকূলের নারীরা অনেক বেশি স্বাস্থ্যঝুঁকিতে থাকেন। দূরদূরান্ত থেকে তাঁদের খাওয়ার পানি সংগ্রহ করতে হয়। স্বাস্থ্যবিধি মানার জন্য তাঁদের নানা সংকট তৈরি হয়। অনেক বেশি মেয়েলি অসুখে আক্রান্ত হন উপকূলের নারীরা। উপকূলীয় অঞ্চলের বেড়িবাঁধ অনেক দুর্বল। জলোচ্ছ্বাসে এসব বাঁধ টেকে না। এসব এলাকায় সরকারিভাবে টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ করতে হবে।

উইমেন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির খুলনা বিভাগীয় প্রধান আইনজীবী শামীমা সুলতানা বলেন, উপকূলীয় এলাকায় জেন্ডার সমতার অভাব গুরুতর। নারীদের ঘর, বাইরের কাজ, মাছ ধরাসহ নানা কাজ সামলাতে বাধ্য, যার ফলে তাঁদের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে। উপকূলীয় এলাকার কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো যদি আর কার্যকর সেবা দিতে পারে, তবে গর্ভবতী নারীসহ অন্য নারীদের দুর্ভোগ কমবে বলে মত দেন তিনি।

খুলনা জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো. হোসেনুর রহমান বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কেউ যদি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, আমরা তাদের সহায়তা করে থাকি। উপকূলীয় অঞ্চলে চর্মরোগের সমস্যাটা অনেক বেশি। এসব অঞ্চলের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অবশ্যই যাতে চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ থাকেন, সে ব্যাপারে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগ নেওয়া উচিত।’

দিঘলিয়া উপজেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা নবনীতা দত্ত বলেন, ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে এখন ইতিবাচকভাবে কাঠামোগত পরিবর্তন আনা হচ্ছে। তবে এখনো কিন্তু পুরোপুরি নারীবান্ধব পরিবেশ সেখানে পাওয়া যায় না। এই অঞ্চলের নারীদের জন্য যুগোপযোগী কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করা দরকার।

জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি হ্রাসে জলবায়ু অভিযোজনের কার্যক্রম তুলে ধরেন উত্তরণের অ্যাকসেস প্রকল্পের দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাস ও ওয়াশ কর্মকর্তা মো. আবু ফেরদৌস চৌধুরী। তিনি বলেন, হেলভেটাসের অর্থায়নে এই প্রকল্পের আওতায় তাঁরা বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জ এবং শরণখোলা উপজেলার আটটি ইউনিয়নে ২৪টি ওয়ার্ডে কাজ করছেন। এই প্রকল্পে দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাস; পানি, স্যানিটেশন ও স্বাস্থ্যবিধি, অ্যাডভোকেসি, জলবায়ু অভিবাসী ও তাদের পরিবারকে সহায়তা, কৃষি তথ্যকেন্দ্রসহ বিভিন্ন বিষয়ে তাঁরা উপকূলের ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলে কাজ করছেন।

উত্তরণের কৃষি কর্মকর্তা আবুল হাসনাত বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের বড় প্রভাব এখন লবণাক্ততায়। গত ১৫ বছরে প্রায় ৯ লাখ হেক্টরের বেশি লবণাক্ত জমির পরিমাণ বেড়েছে। এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা দরকার।

প্রকল্পের উপকারভোগী মোরেলগঞ্জের রনি হাওলাদার বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড় সিডরের পর আমাদের এলাকার কৃষি মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ধানের উৎপাদন এখনো খুবই কম। পাশাপাশি প্রাণিসম্পদ খাতে একটা বিপর্যয় এসেছে। এলাকায় পশুখাদ্যের খুবই সংকট।’

সংলাপে খুলনা প্রেসক্লাবের আহ্বায়ক এনামুল হক, উত্তরণের টেকনিক্যাল ম্যানেজার রেজওয়ান উল্লাহ, খুলনার সংবাদকর্মী আবু হেনা মোস্তফা জামাল, কৌশিক দে, আহমেদ মুসা, বাগেরহাটের সংবাদকর্মী ইনজামামুল হক, তানজীম আহমেদ বক্তব্য দেন।

অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ফিরোজ চৌধুরী। স্বাগত বক্তব্য দেন প্রথম আলোর খুলনা প্রতিনিধি উত্তম মণ্ডল।