বনে দেখা দুষ্প্রাপ্য আরজান
বছরের পর বছর ধরে আমাদের বন–পাহাড়ে বিপুল ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর পরও কিছু কিছু উদ্ভিদ অদম্য প্রাণশক্তি নিয়ে জীবনের জয়গান গেয়ে চলেছে। মানুষের হিংস্রতা এড়িয়ে লড়াই করে টিকে থাকা এসব উদ্ভিদের সন্ধানে সারা দেশে ঘুরে বেড়াই। বান্দরবানের লামায় অবস্থিত কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের অরণ্য প্রকৃতিতে বেশ কিছু দুর্লভ উদ্ভিদ রয়েছে। এসব উদ্ভিদের অধিকাংশই সেখানে প্রাকৃতিকভাবে জন্মে। বাকি উদ্ভিদগুলো রোপণ করা। রোপণকৃত উদ্ভিদের মধ্যে সেখানকার প্রাকৃতিক আবাস থেকে নানা কারণে হারিয়ে যাওয়া উদ্ভিদের সংখ্যাই বেশি। ফলে গত কয়েক দশকে স্থানটি উদ্ভিদ-বৈচিত্র্যে বেশ সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছে। দেশে আসা নতুন উদ্ভিদ নিয়েও গড়ে তোলা হয়েছে চমৎকার সংগ্রহশালা। ঋতুর পালাবদলের সঙ্গে সেখানে বিচিত্র ফুলের সমাবেশ ঘটে। এ কারণে স্থানটি প্রকৃতিপ্রেমীদের কাছে অনেকটা তীর্থকেন্দ্রের মতো।
বছরে দু–একবার সেখানে যাওয়া হয়। শুধু অরণ্য-প্রকৃতি নয়, বিশাল পরিসরের কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের বিপুল কর্মযজ্ঞ উল্লেখ করার মতো। আমার কাজ উদ্ভিদ-সন্ধান, তার রহস্য উন্মোচন বা না চিনলে চেনার চেষ্টা করা। শৈলসারির ভাঁজে ভাঁজে জন্মানো উদ্ভিদ আর তৃণ-গুল্মগুলো প্রতিবারই চমকে দেয়। পাওয়া যায় কোনো না কোনো নতুন ফুল বা উদ্ভিদ। আমাদের বন-পাহাড়ে প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো এমন অনেক গাছ বর্তমানে বিপন্ন। খুবই হতাশাব্যঞ্জক কথা। এখানকার প্রকৃতিতে জন্মানো এমন বিপন্ন উদ্ভিদের তালিকাও বেশ দীর্ঘ। প্রতিবছরই তাতে যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন নাম। তবে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের এই গাছগুলো বেশ নিরাপদে এবং স্বাভাবিকভাবেই বেঁচে আছে।
কয়েক বছর আগের কথা। বান্দরবানের লামা থেকে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা প্রকৃতিপ্রেমী সাইফুদ্দিন সাইফ একটি ফুলের ছবি পাঠালেন। অচেনা ফুল। আগে দেখিনি। বইপত্র ঘেঁটে গাছটির বাংলা নাম পাওয়া গেল। স্থানীয়ভাবে এ গাছ আরজান, অরজান বা আরজাম নামে পরিচিত। ব্রিটিশ ভারতের অরণ্যতরু সন্ধানী জোসেফ ডালটন হুকার ১৮৭২ সালে গাছটি প্রথম শনাক্ত করেন। কিছুদিন পর সরেজমিন গাছটি দেখার সুযোগ হলো। তখন ফুল শেষ হয়ে গাছে ফল এসেছে। ফলের ছবি তোলার জন্য বেশ কসরত করতে হয়েছিল। উচ্চতা ও চারপাশে গাছপালার ঘনত্ব ছবি তোলার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছিল।
আরজান (Monoon semiarum) মাঝারি আকারের দ্বিবীজপত্রী উদ্ভিদ। শাখা, কাণ্ড ও ডালপালা মসৃণ। পাতা ৫ থেকে ৭ মিমি লম্বা, পত্রবৃন্তবিশিষ্ট, ডিম্বাকৃতি বা আয়তাকার থেকে বল্লমাকার। পুষ্পবিন্যাস গুচ্ছিত আকারে পুরাতন কক্ষে বা কাষ্ঠল গুটিকায় অবস্থিত। ফুল আড়াই থেকে সাড়ে তিন সেমি লম্বা, হরিদ্রাভ-সবুজ। পুষ্পবৃন্তিকা ১ দশমিক ২ থেকে সাড়ে তিন সেমি লম্বা, সরু, মঞ্জরিপত্র ১ বা ২টি। বৃত্যংশ ২ থেকে ৩ মিমি লম্বা, বহিরাংশ রোমশ। ফুলের পাপড়ি সংখ্যা ৬, মুক্ত, বিভিন্ন আকৃতির, চ্যাপ্টা, ছড়িয়ে থাকা বাইরের পাপড়িগুলো ভেতরের পাপড়ির চেয়ে সামান্য ছোট। পরিপক্ব গর্ভপত্র ১০টি, ৩ থেকে সাড়ে ৩ সেমি লম্বা, বিডিম্বাকার, মসৃণ, পরিণত অবস্থায় কমলা-লাল থেকে নীল-কালো রঙে রূপান্তরিত হয়। ফুল ও ফলের সময় মে থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত বিস্তৃত। পাকা ফল উপবৃত্তাকার, মাংসল ও বৃন্তযুক্ত। বীজ খাঁজকাটা, সাধারণত ১টি, কখনো কখনো ৫টিও হতে পারে।
এ গাছ ভারত, ভুটান, মিয়ানমার, লাওস ও থাইল্যান্ডে সহজলভ্য। বাংলাদেশে ১৯৫৫ সালে কক্সবাজার থেকে গাছটি নথিভুক্ত করা হয়েছে। এ গাছের কাঠ চায়ের বাক্স তৈরিতে ব্যবহার্য। বাকলের আঁশ থেকে দড়ি তৈরি করা হয়। কোথাও কোথাও জ্বালানি কাঠ হিসেবেও এ গাছের ব্যবহার লক্ষ করা যায়। বীজের মাধ্যমেই বংশবৃদ্ধি করা যায়।
মোকারম হোসেন, প্রকৃতি ও পরিবেশবিষয়ক লেখক