সকাল গড়িয়েছে খানিকটা। তখনো ঘাস, মৃত্তিকা আর ঝরাপাতাগুলো ততটা তেতে ওঠেনি। কোলাহলহীন স্নিগ্ধ বাতাস কেটে ছুটছে আমাদের গাড়ি। যাচ্ছি যশোর থেকে নড়াইল। দুপাশের দৃশ্য যথারীতি মনোমুগ্ধকর। সুবিশাল কাণ্ডের বৃক্ষগুলো এই মায়াবী পথের ছায়া-মায়ার কারুকাজ হয়ে আছে যেন।
কিন্তু আনন্দময় এই প্রকৃতিদর্শন অচিরেই বিষাদে ভরে উঠল! কেন? যখন আমরা বুঝতে পারি এই মহিরুহ বৃক্ষগুলো প্রতিমুহূর্তেই মৃত্যুর প্রহর গুনছে! কারণ, তাদের গায়ে ঝুলছে লাল রঙের নম্বরসংবলিত মৃত্যু পরোয়ানা। রীতিমতো হত্যা মামলায় সাজাপ্রাপ্ত আসামি যেন ওরা।
ডেথ সেলের কয়েদিদের মতো ওদের যদি জিজ্ঞেস করা যেত তোমাদের শেষ ইচ্ছাটুকু কী; আর যা-ই হোক, ওরা নিশ্চয় এমন মৃত্যু চাইত না। আমরাই–বা কীভাবে এমন মহিরুহগুলোর মৃত্যু প্রত্যাশা করি। কারণ, শতোর্ধ্ববর্ষী এসব বৃক্ষের পত্রপল্লব, কাণ্ড-ডালপালা অপার রহস্যে ঘেরা একেকটি মনোদ্যানের মতোই। যার পরতে পরতে লুকিয়ে আছে অনন্তকালের ইতিহাস। এ বৃক্ষগুলোর এমন পরিপূর্ণ শিল্পকর্ম আর কী হতে পারে?
জীবনের জন্য অপরিহার্য উদ্ভিদজগৎ নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বনবাণীর ভূমিকায় কী বলেছেন দেখুন, ‘আমার ঘরের আশেপাশে যে-সব আমার বোবা-বন্ধু আলোর প্রেমে মত্ত হয়ে আকাশের দিকে হাত বাড়িয়ে আছে, তাদের ডাক আমার মনের মধ্যে পৌঁছল। তাদের ভাষা হচ্ছে জীবজগতের আদিভাষা, তার ইশারা গিয়ে পৌঁছয় প্রাণের প্রথমতম স্তরে; হাজার হাজার বৎসরের ভুলে-যাওয়া ইতিহাসকে নাড়া দেয়। মনের মধ্যে যে-সাড়া ওঠে সেও ঐ গাছের ভাষায় তার কোনো স্পষ্ট মানে নেই, অথচ তার মধ্যে বহু যুগযুগান্তর গুনগুনিয়ে ওঠে।’
জীবনানন্দ দাশ বলেছেন, ‘পৃথিবীর কোনো পথে; নরম ধানের গন্ধ-কলমীর ঘ্রাণ’ অথবা ‘সাতশো বছর কেটে গেছে তারপর তোমাদের আম জাম কাঁঠালের দেশে।’
আমেরিকার তরুণ কবি অ্যালফ্রেড জয়েস কিলমার বৃক্ষ নিয়ে ১০ লাইনের একটি কবিতা লিখেছিলেন। তিনি অমর হয়ে আছেন বৃক্ষ নিয়ে লেখা এই একটিমাত্র কবিতার জন্য। কবিতার শুরুতে তিনি বলেন, ‘মনে হয় বৃক্ষের মতো সুন্দর একখানা/ কবিতা আমি কস্মিনকালেও দেখব না।’ কবিতাটির শেষে তিনি বলেছেন, ‘কবিতা জন্ম নেয় আমার মতো মূর্খদের হাতে/ কিন্তু একমাত্র বিধাতাই পারেন বৃক্ষ জন্মাতে।’
কবি, সাহিত্যিক, দার্শনিক ও বিজ্ঞানীদের মুখে উদ্ভিদ নিয়ে এমন অসংখ্য স্তুতিবাক্য অনেক শোনা যায়। তাঁরা অন্তরাত্মা দিয়ে প্রকৃতিকে অনুভব করেন। কিন্তু আমাদের বৃক্ষ হত্যার হুকুমদাতারা এসব অনুভব করেন না। তাঁদের কাছে একটি শতোর্ধ্ববর্ষী বৃক্ষ যা, একটি আগাছাও তা।
তাই তাঁরা একসঙ্গে সহস্র বৃক্ষের মৃত্যু পরোয়ানা জারি করেন। মেতে ওঠেন বৃক্ষ হত্যার উৎসবে। অথচ ইচ্ছা করলেই এক পাশের বৃক্ষগুলো রেখে সড়ক প্রশস্ত করা সম্ভব ছিল। তাতে অন্তত একদিকের বৃক্ষগুলো রক্ষা পেত। এটা শুধু আবেগ বা ভালোবাসার বিষয় নয়, প্রাকৃতিক ভারসাম্যের বিষয়ও।
সতীর্থ বৃক্ষভক্ত যায়েদ আমীন এই মনখারাপ সড়কটির শেষ প্রান্তে এসে তাঁর পর্যবেক্ষণ জানালেন, বৃক্ষহত্যার এই উৎসবে কালের সাক্ষী প্রবীণতম বৃক্ষের সংখ্যাই বেশি। যার মধ্যে বকুল, মেহগনি, শিরীষ, নিম, অর্জুন, শিমুল, গাব, হিজল, মিনজিরি, কাঁঠাল, আমলকী, বেল, তেঁতুল, হিজল, কালোজাম, আম, ছাতিম, দেবদারু, কৃষ্ণচূড়া, সফেদা ইত্যাদি অন্যতম। জেলা প্রশাসনকে এ বিষয়ে যথেষ্ট সংবেদনশীল হওয়া প্রয়োজন।
মোকারম হোসেন, প্রকৃতি ও পরিবেশবিষয়ক লেখক