জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের উদ্ভিদ–গবেষক ও প্রকৃতিপ্রেমী আবদুর রহিম খবর দিলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের অরণ্যে ভুঁই ডালিমের ফুল ফুটছে। দেখতে হলে খুব ভোরেই যেতে হবে। রোদ উঠতে উঠতেই ফুল ঢলে পড়ে। এপ্রিলের ১৩ তারিখ ভোরেই ঢাকা থেকে সাভারের উদ্দেশে রওনা দিলাম। প্রকৃতিদর্শন বলে কথা!
কিন্তু রাস্তার ট্রাফিক জ্যামে সে বেলাই হয়ে গেল, পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রায় আটটা বেজে গেল। আর ঘণ্টাখানেক আগে গেলে হয়তো এই আফসোসটুকু পোড়াত না। তবে প্রকৃতিদেবীর তো ঐশ্বরিক কিছু ক্ষমতা আছে, তিনি ভক্তের কথা ঠিকই বুঝতে পারেন। তাই সে বনের প্রান্তে নিচু ঢালে প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো শ খানেক ভুঁই ডালিমগাছের অনেকগুলো গাছেই ফুল ফোটার লক্ষণ স্পষ্ট দেখলাম, কিন্তু ফুলগুলো সব বোঁটা থেকে খসে পড়েছে। ছবি তুলব কার? অবশেষে রহিম ভাই সহায় হলেন, খুঁজে খুঁজে একটি ফুল বের করলেন। হয়তো ও ফুলটার ঘুম ভাঙতে একটু দেরি হয়েছিল বা প্রকৃতিদেবী তার অদৃশ্য ইশারায় ওই ফুলকে তা করতে বলে দিয়েছিলেন। সে জন্যই আমরা সেই দুর্লভ ফুলের দেখা পেলাম এবং কিছু ছবি তুলে ফেললাম।
দুর্লভ বলছি এ কারণে যে ভুঁই ডালিম দেশের এক মহাবিপন্ন উদ্ভিদ। বাংলাদেশ ন্যাশনাল হার্বেরিয়াম প্রকাশিত রেড ডাটা বুক অব ভাস্কুলার প্লান্ট বইয়ের দ্বিতীয় খণ্ডে এ গাছকে লাল তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। রহিম ভাই জানালেন, এ দেশে এ গাছ সহজে দেখা যায় না।
ভুঁই ডালিমের উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম Careya herbacea ও গোত্র লেসিথিডেসি। এটি একটি ছোট আকারের বহুবর্ষজীবী ভূসংলগ্ন উপগুল্ম প্রকৃতির ছোট বা ক্ষুদ্র আকৃতির গাছ। গাছের কাণ্ড কাষ্ঠল হলেও তা মাটির ওপর থেকে প্রায় দেখাই যায় না। দেখলাম, গাছগুলো তামাচারার মতো পাতা মেলে ভূপৃষ্ঠ ছেয়ে ফেলেছে। চারদিকে তির্যকভাবে ছড়ানো সবুজ কোমল পাতার কেন্দ্রস্থলের কাণ্ডে থাকা পাতার কোল থেকে লম্বা বোঁটায় কুঁড়ি ও ফুল বের হয়েছে। রয়্যাল বোটানিক গার্ডেন কিউ-এর তথ্যানুসারে, ১৮১৯ সালে প্লান্টস অব দ্য কোস্ট করোমন্ডল-এর তৃতীয় খণ্ডের প্রথম অংশে উইলিয়াম রক্সবার্গ প্রথম এই গণের বর্ণনা দেন। প্লান্ট করোমণ্ডল সাময়িকীতে ১৮১৯ সালেই প্রথম এই উদ্ভিদের বর্ণনা প্রকাশ করা হয়।
রহিম ভাই জানালেন, উদ্ভিদবিজ্ঞানী হুকার ১৮৭৯ সালে চট্টগ্রামের ভুঁই ডালিম রয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন কিন্তু আজ পর্যন্ত সেখানকার পাহাড়ি এলাকায় এর উপস্থিতি দেখা যায়নি। এ গাছের প্রাকৃতিক আবাসস্থল হলো শালবনের মধ্যে থাকা জলাশয়গুলোর পাড়। কিন্তু টাঙ্গাইলের কয়েকটি শালবন ঘুরেও কখনো এর দেখা পাইনি।
এর ফুল ফোটে মার্চের শেষ থেকে এপ্রিলের মাঝামাঝি পর্যন্ত। শেষ রাতে ফুল ফোটে। ফুল দেখতে অনেকটা কুম্ভী ফুলের মতো। তাই একে ছোট কুম্ভী বললেও বোধ হয় ভুল হবে না। ফল ধরে মে মাসের শেষ দিকে, ফল যেন দুপ্রাষ্প্য। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভুঁই ডালিমের যে পট্টির মতো খানিকটা জায়গা রয়েছে, সেখানে প্রায় এক শ ভুঁই ডালিমের গাছ আছে। এগুলোর মধ্যে দেখা পাওয়া গেছে মাত্র একটি ফলের। ফল দেখতে অনেকটা গোলাপজাম বা ডালিমের আকৃতিবিশিষ্ট, ফলের বোঁটা মাটিতে প্রোথিত। ডিম্বাকার ফলের অগ্রপ্রান্তে সুতার মতো একটি লম্বা গর্ভকেশর ও চারটি বৃতি স্থায়ীভাবে দেখা যায়।
এ গাছের আদিনিবাস উত্তর ভারত থেকে চীন পর্যন্ত বিস্তৃত, বিশেষ করে হিমালয়ের পার্বত্যাঞ্চল। নেপাল, ভুটান, ভারত ও বাংলাদেশে এ গাছের বিস্তৃতি রয়েছে। সাধারণত বনতলে জন্মে থাকে, একবার কোথাও জন্মালে সেখানে বংশবৃদ্ধি করতে থাকে অনেক বছর ধরে। সৌভাগ্য যে এ দেশে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অরণ্য প্রান্তে ভুঁই ডালিমের সন্ধান পাওয়া গেছে। তাই গবেষক ও উদ্ভিদপ্রেমীদের উচিত হবে একে সংরক্ষণ করা ও বংশবিস্তার করে এর প্রাকৃতিক আবাসস্থলে ছড়িয়ে দেওয়া।
মৃত্যুঞ্জয় রায়, কৃষিবিদ ও প্রকৃতিবিষয়ক লেখক