বালিহাঁসের ১০টি ছানা

বালিহাঁসের ছয়টি ছানার চারটি
ছবি: রাশেদ বিশ্বাস

তিন বিঘা আয়তনের পুকুরটির নাম ‘ঠাকুর পুকুর’। পুকুরের উত্তর পাড়ে নিজের মুখি কচুর খেতে কাজ করছিলেন তরুণ সেলিম শেখ। পাল আমলের ওই পুকুরের চার পাড়ে রয়েছে তাল, খেজুর ও নারকেলের প্রচুর গাছ। ৫০ বছর আগে আরও বেশি ছিল। তখন তাল, নারকেল ও খেজুরের মরা গাছের মাথার কোটরে নিয়মিত বাসা বানিয়ে ডিম ও ছানা তুলত বালিহাঁস। ডিম ফুটে ছানা হওয়ার পরে ছানাগুলো একে একে (এক দিনে নয়) উঁচু গাছ থেকে লাফিয়ে পুকুরের জলে পড়ত। সে এক কাব্যিক-শৈল্পিক দৃশ্য।

কাজ করতে করতে সেলিম শেখ দেখলেন, দুজন নারী খেতের অন্য প্রান্তে দৌড়াদৌড়ি করছেন, ধাওয়া করছেন কোনো কিছু। এগোলেন তিনি। ততক্ষণে একজন ধরেছেন বালিহাঁসের চারটি ছানা, অন্যজন দুটি। সেলিম দেখলেন, মা বালিহাঁস আরও চারটি ছানা পেছনে রেখে এক সারিতে দ্রুত হেঁটে অনতিদূরের ‘দইসরা’ বিলের দিকে যাচ্ছে। মা বালিহাঁস দুপুরের নির্জনতায় ছানাগুলোকে নিয়ে পাড়ি দিচ্ছিল ডাঙার ওপর দিয়ে। ওই পুকুরপাড়েরই একটি মরা তালগাছের মাথার কোটর থেকে ১০টি ছানাই নেমেছিল লাফ দিয়ে। দুটি ছানাকে লাফ দিতে দেখেছিলেন সেলিমও।

এ ঘটনা গত ২৫ জুলাইয়ের। স্থান সাতক্ষীরার তালা উপজেলার ভায়ড়া গ্রাম। উল্লেখ৵, বালিহাঁসের বাসা, ডিম ও ছানা নিয়ে আমার রয়েছে বেশ অভিজ্ঞতা। ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত বৃহত্তর খুলনা অঞ্চলে তাল, নারকেল ও খেজুরের অসংখ্য মরা গাছ ছিল। প্রতি মৌসুমে সেখানে প্রচুর বাসা হতো। তৃতীয় শ্রেণি থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করা পর্যন্ত এমন কোনো বছর নেই, যে বছর একাধিক বাসা থেকে সংগ্রহ করা ১৫ থেকে ২০টি ছানা আমরা পুষিনি। আমার লেখা বই বাংলাদেশের বুনো হাঁস–এ (২০১২) বালিহাঁসের বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে। সেলিম শেখ স্থানীয় ওয়াইল্ডলাইফ মিশনের বন্য প্রাণী উদ্ধার ও ব্যবস্থাপনাবিষয়ক সম্পাদক। মিশনের সম্পাদক রাশেদ বিশ্বাস ও সভাপতি জুলফিকার মতিনকে সেলিম শেখ নিয়ে গেলেন উল্লিখিত দুই নারীর বাড়িতে। না, ছানা তাঁরা দেবেন না। তখন ফোন করা হলো খুলনার প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের মফিজুর রহমান চৌধুরী, স্থানীয় বন বিভাগের কর্মকর্তা ও ঢাকার বন্য প্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের সদস্য শেখ জসীমকে। ওই তিনজনও কথা বললেন ওই দুই নারীর সঙ্গে। পরে ভীত হয়ে তাঁরা ছয়টি ছানা দিয়ে দিলেন। একটি ছানার পায়ে আঘাত লেগেছিল। ৬টি ছানা গত ২৬ জুলাই সকালে ঠাকুর পুকুরে ছেড়ে দেওয়া হলো। কিছুক্ষণ পরেই মা পাখিটি এল। ছয়টি ছানা নিয়ে পুকুরের সরু পাড় বেয়ে উঠল মা। পাঁচটি ছানা মাকে অনুসরণ করতে পারলেও আঘাত পাওয়া ছানাটি পারল না। ছানা পাঁচটি নিয়ে মা বালিহাঁস চলে গেল সেই দইসরা বিলে, যেখানে রয়েছে বাকি চারটি ছানা। আঘাত পাওয়া ছানাটি গত ৩০ জুলাই মিশে যায় ৬টি সমবয়সী ডাহুকছানার সঙ্গে। ডাহুক মা–ও আপন করে নিয়েছে ছানাটিকে।

উল্লিখিত ছানাগুলো ছিল বাংলাদেশের সবচেয়ে ছোট বুনো হাঁস বালিহাঁসের। এগুলো বাগেরহাটে ‘ভেড়ার কোট’ নামে ব্যাপক পরিচিত। এ ছাড়া বেলেহাঁস, মালাহাঁস, তুলোহাঁস, কড়িহাঁস নামেও পরিচিত। সাতক্ষীরায় নাম ব্যালহাঁস। ইংরেজি নাম কটন পিগমি–গুজ। বৈজ্ঞানিক নাম Nettapus coromandelianus.