গাছের সংকটে বুনো প্রাণীরা
মাথার ওপর দিয়ে হঠাৎ উড়ে গেল একঝাঁক উদয়ী ধনেশ। ১৫-২০টি হবে। এতগুলো ধনেশ পাখির পরপর উড়ে যাওয়ার দৃশ্য সাম্প্রতিক সময়ে খুবই বিরল।
বলছি ২০২১ সালের কথা। সেবার বর্ষায় গিয়েছিলাম রাঙামাটির কাসালং বনে। দেশের সবচেয়ে গহিন অঞ্চল বলেই জায়গাটার পরিচিতি। ধনেশগুলোর দেখা পেয়েছি বনের একেবারে গভীরে। বনের সে অংশে সারি সারি চেনা-অচেনা উঁচু বৃক্ষ। বুনো ফলের গাছগুলোতেই ধনেশের আনাগোনা। একসময় পার্বত্য চট্টগ্রামজুড়ে ছিল ধনেশের উপস্থিতি। এখন আর তেমন দেখা যায় না। কাসালং বনই এখন তাদের টিকে থাকার ভরসা।
সেই বছরই একটি ডুমুরগাছে রাজধনেশের দেখা পেয়েছিলাম সাঙ্গু-মাতামুহুরী বন্য প্রাণীর অভয়ারণ্যে। পাকা ডুমুর ওদের খুব প্রিয়। এ দেশের বুনো পাখির মধ্যে রাজধনেশই সবচেয়ে বড় পাখি। বাহারি ঠোঁটের পাখিটি কেবল গাছের অভাবে হারিয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।
উল্লুক বনের মহাবিপন্ন একটি স্তন্যপায়ী প্রাণী। উঁচু গাছের ওপরের দিকের ডালে এরা খাবার খোঁজে। কখনো মাটিতে নামে না। চাপালিশ, বনডুমুর, বনকাঁঠাল, বনজাম আর বট তাদের প্রিয় গাছ। মৌলভীবাজারের লাউয়াছড়া বনে এই গাছগুলো ভালোই দেখা যায়। উল্লুকের উপস্থিতিও সেখানে তাই ভালো। অন্য বনগুলোয় উঁচু গাছ কমে যাওয়ায় এদের বিচরণ এলাকা সংকুচিত হয়ে এসেছে। কমতে কমতে উল্লুকের সংখ্যাও নেমে এসেছে পাঁচ শর নিচে।
হাওর এলাকায় গেলে সহজেই দেখা মেলে হিজল, করচ আর বরুণগাছের। গাছগুলো বর্ষায় পানির নিচে ডুবে থাকলেও শীতে সারি সারি গাছ মাথা উঁচু করে আবার জেগে ওঠে। এসব জাতের গাছে বাসা বানায় পালাসের কুড়া ইগল। মিঠাপানির জলার এসব গাছও হারিয়ে যাচ্ছে হাওর থেকে। তাই পরিযায়ী ইগলও সংকটের মুখে পড়েছে।
আমাদের বনগুলোতে টিকে আছে প্রায় আড়াই শ হাতি। বনের ভেতর বাঁশ, ফুলঝাড়ু, ছোট লতাগুল্ম, কলাগাছ, ঘাস আর গাছের বাকল হাতির খুবই প্রিয়। এসব গাছ এখন কমে যাওয়ায় হাতির খাবারে টান পড়েছে। বনের ভেতর তাদের খাবার না থাকায় হাতি এখন লোকালয়ে চলে আসছে। মুখ দিচ্ছে ফসলি জমিতে। দ্বন্দ্ব বাড়ছে মানুষ ও হাতির।
বাংলা শকুনেরও প্রিয় কিছু গাছ আছে। উঁচু গাছই শকুনের পছন্দ। পাতা কম থাকলে ন্যাড়া গাছে শকুন বিশ্রাম নিতে ভালোবাসে। প্রায় সময় দেখা যায়, বড় শিমুলগাছে বসে শকুন বিশ্রাম নিচ্ছে। হবিগঞ্জের নবীগঞ্জে একটি বড় আমগাছে কয়েক বছর আগে বাসা বেঁধেছিল বেশ কয়েকটি শকুন। খুলনার বটিয়াঘাটায় কয়েকটি বড় নারকেলগাছে শকুন বিশ্রাম নিত। চা-বাগানের পাতাহীন মেঘশিরীষগাছও শকুনের খুব প্রিয়। পাবনার বেড়া উপজেলায় নারকেল আর দেবদারুগাছেও এরা বাসা বানায় নিয়মিত।
সম্প্রতি আমাদের গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, দেশে যে কটি শকুন টিকে আছে, সেগুলো বিশ্রাম ও বাসা বানানোর জন্য চার জাতের গাছ পছন্দ করে—গর্জন, বনাক, শিমুল ও জাম। সুন্দরবনে সুন্দরীগাছের পাশাপাশি অন্যান্য গাছেও সম্প্রতি বাসা বানানোর তথ্য আছে।
বেশ কয়েক জাতের পাখি তালগাছ পছন্দ করে। তালগাছই বাবুই পাখির বাসা বানানোর প্রধান বৃক্ষ। বাবুইয়ের বাসা বোনা প্রাণিজগতের এক অনন্য উদাহরণ। প্রতি প্রজনন মৌসুমে পুরুষ বাবুই তালগাছে বাসা বানিয়ে মেয়ে সঙ্গীকে আকৃষ্ট করে। মেয়ে পাখি বাসা পরখ করে। পছন্দ হলে প্রণয় হয়। গ্রামীণ জনপদের সবচেয়ে প্রিয় তালগাছও কমে যাচ্ছে।
এ ছাড়া বাঁশঝাড় পছন্দ প্যাঁচার, মৌটুসির পছন্দ ফুলগাছ, কালেম আর দলপিপির পছন্দ নলখাগড়া।
গ্রামীণ জনপদ বা গহিন বন, সব জায়গায় বন্য প্রাণীদের প্রিয় গাছগুলো দিন দিন বিপজ্জনক হারে কমছে। বুনো প্রাণীর টিকে থাকা অনেকটাই নির্ভর করছে তাদের আবাসস্থলের ওপর। এই সংকট মোকাবিলায় মানুষকেই সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখতে হবে।
সীমান্ত দীপু বন্য প্রাণী গবেষক