মানিকজোড়ের রকমফের

রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার বিজয়নগরে একটি উড়ন্ত মানিকজোড়
ছবি: লেখক

গলায় উলের মতো সাদা মাফলার পরা তুলো-গলার সারসটিকে প্রথম দেখি থাইল্যান্ডের রাজকীয় ডুসিত চিড়িয়াখানায় ২০০৬ সালে। তবে প্রকৃতিতে প্রথম দেখার সৌভাগ্য হলো ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৮-এ রাজশাহীর গোদাগাড়ীর বিজয়নগরে একটি মুঠোফোনের টাওয়ারে। যদিও কিছুটা দেরিতে পৌঁছানোর কারণে প্রথমেই বড় পাখি জোড়ার সঙ্গে দেখা হয়নি। টাওয়ারের ওপর বানানো বাসার দিকে তাকাতেই ছানা দুটিকে দেখতে পারলাম।

কিন্তু টাওয়ারের কিনারায় না আসায় ওদের ছবি তোলা গেল না। প্রায় ৪৫ মিনিট অপেক্ষার পর ওদের বাবা-মায়ের একজন খাবার মুখে উড়ে এসে টাওয়ারে দাঁড়াতেই ওরা ঝাঁপিয়ে পড়ল। ছানাদের খাইয়ে-দাইয়ে পাখিটি টাওয়ারের কিনারায় এসে দাঁড়াল। ক্যামেরার ভিউ ফাইন্ডারে চোখ রেখে যে–ই না শাটারে ক্লিক করতে যাব, অমনি সে উড়াল দিল। আমার আঙুলও কিন্তু বসে রইল না, সমানে ক্লিক করে গেল। আর পেয়ে গেলাম দারুণ সব উড়ন্ত ছবি।

এ দেশের একসময়ের আবাসিক, পরবর্তী সময়ে পরিযায়ী ও মহাবিপন্ন তুলো-গলার পাখিটি হলো মানিকজোড়। ওরা এখন নিয়মিত ওখানে ডিম-ছানা তুলছে। দেশের আবাসিক পাখির তালিকায় আবারও পাখিটি যুক্ত হওয়ায় আমাদের প্রকৃতি কিছুটা হলেও সমৃদ্ধ হলো।

বড় থেকে বিশাল আকারের লম্বা চঞ্চু, পা ও গলাবিশিষ্ট জলচর পাখিটি দীর্ঘজঙ্ঘ বা চিকোনিফরমেস বর্গের অন্তর্ভুক্ত। বিশ্বব্যাপী এই বর্গে ২০ প্রজাতির পাখি থাকলেও এ দেশে দেখা যায় ৯টি, যারা বর্গের একমাত্র গোত্র চিকোনিডির অন্তর্ভুক্ত। ওদের সাধারণ নাম মানিকজোড় হলেও শামুকখোল, মদনটাক ও হাড়গিলা এসব নামে পরিচিত নয়। এখানে বাকি ছয়টি মানিকজোড়ের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দেওয়া হলো।

এক. মানিকজোড় (উলি-নেকড স্টর্ক): যে গল্পটি দিয়ে লেখা শুরু করেছিলাম, সেটিই মানিকজোড়। সাদা-গলা বা তুলো-গলা মানিকজোড় নামেও পরিচিত। সচরাচর রাজশাহী, খুলনা ও ঢাকা বিভাগের জলাভূমি, নদী ও চরাঞ্চলে একাকী, জোড়ায় বা ছোট দলে বিচরণ করে। এশিয়া ও আফ্রিকায় ওদের বিস্তৃতি রয়েছে। প্রাপ্তবয়স্ক পাখির উচ্চতা ৮৫ সেন্টিমিটার। ৮৫ থেকে ৯৬ সেন্টিমিটার লম্বা পাখিটির ওজন ২.১ কেজি। আয়ুষ্কাল প্রায় ১৬ বছর।

দুই. রাঙা মানিকজোড় (পেইন্টেড স্টর্ক): মহাবিপন্ন পরিযায়ী পাখিটি সোনাজঙ্ঘা, রঙিলা বা চিত্রা বক বা রঙিলা সারস নামেও পরিচিত। সাঁওতালরা বলে জাংগিল। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আবাসিক পাখিটি বর্তমানে বিশ্বে প্রায় শঙ্কাগ্রস্ত। রাজশাহী ও বরিশাল বিভাগে বেশি দেখা যায়। গত ১১ নভেম্বর ৩২টি পাখির দুটি ঝাঁককে পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে উড়ে যেতে দেখেছি। পাখিটি লম্বায় ৯৩ থেকে ১০২ সেন্টিমিটার; ওজন ২.০-৩.৫ কেজি। আয়ুষ্কাল প্রায় আট বছর।

তিন. কালো গলা মানিকজোড় (ব্ল্যাক-নেকড স্টর্ক): বাংলাদেশের আবাসিক ও পরিযায়ী পাখির মধ্যে আকারে সবচেয়ে বড় সারসটি লোহারজঙ্গ বা রামশালিক (পশ্চিমবঙ্গ) নামেও পরিচিত। এরা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও অস্ট্রেলিয়ায় বিস্তৃত। বিরল ও বিপন্ন ভবঘুরে পাখিটি শীতে অনিয়মিতভাবে এ দেশে আসে। জানামতে, ২০১১ সালে হাকালুকি হাওরে প্রথমবার দেখা যায়। রাজশাহীর পদ্মার চরে ২০১৬ সালে প্রথম ছবি তুলি। এরপর মাত্র দু–একবার এ দেশে দেখা গিয়েছিল। প্রাপ্তবয়স্ক পাখির উচ্চতা ১২৯ থেকে ১৫০ সেন্টিমিটার; ওজন ৪.১ কেজি। আয়ুষ্কাল ১০ বছরের বেশি।

চার. কালো মানিকজোড় (ব্ল্যাক স্টর্ক): পশ্চিমবঙ্গে এটি কালাজাং বা কালো কাক নামে পরিচিত। বিরল ও সংকটাপন্ন পরিযায়ী সারসটিকে শীতে রাজশাহী, ঢাকা ও চট্টগ্রামের নদীতীর, হ্রদ ও জলাশয়ে দেখা যায়। বিশ্বব্যাপী এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপে বিস্তৃতি। গড় উচ্চতা ১০২ সেন্টিমিটার। লম্বায় ৯০ থেকে ১০০ সেমি। গড় ওজন ৩ কেজি। আয়ুষ্কাল প্রায় ১৬ বছর।

পাঁচ. সাদা মানিকজোড় (হোয়াইট স্টর্ক): এটি উজলি বা ঢাক নামেও পরিচিত। ইউরোপ, আফ্রিকা, এশিয়ার উত্তরাঞ্চল ও মধ্যপ্রাচ্যের সারসটি কালেভদ্রে এ দেশে ভবঘুরে হয়ে আসে। আমি পাখিটিকে ইতালির রোম চিড়িয়াখানায় দেখেছি। প্রাপ্তবয়স্ক পাখির উচ্চতা ১০০ থেকে ১২৫ সেন্টিমিটার। লম্বায় ১০০ থেকে ১১৫ সেন্টিমিটার; ওজন ২.৩ থেকে ৪.৪ কেজি। আয়ুষ্কাল ২২ থেকে ২৩ বছর।

ছয়. কালো চঞ্চু সাদা মানিকজোড় (ওরিয়েন্টাল স্টর্ক): উত্তর সাইবেরিয়া ও চীনের আবাসিক পাখিটি অনিয়মিতভাবে এ দেশে আসে। অত্যধিক শিকার ও আবাস ধ্বংসের কারণে বর্তমানে বিশ্বব্যাপী পাখিটি বিপন্ন হয়ে পড়েছে। ১৯৯৮ সালে পাখিটিকে বাগেরহাটের বিল কোদালিয়ায় দেখেছিলাম, তবে ছবি তুলতে পারিনি। প্রাপ্তবয়স্ক পাখির উচ্চতা ১১০ থেকে ১৫০ সেন্টিমিটার। লম্বায় ১০০ থেকে ১২৯ সেন্টিমিটার। পুরুষ ও স্ত্রীর গড় ওজন যথাক্রমে ৫.২০ ও ৪.৩৫ কেজি। আয়ুষ্কাল ১৬ বছরের বেশি।

  • আ ন ম আমিনুর রহমান, পাখি ও বন্য প্রাণী প্রজনন ও চিকিৎসাবিশেষজ্ঞ