তেঁতুলিয়ার কাজীপাড়ার পাখিরা
পৃথিবীতে অনেক মানুষ আছেন, যাঁরা নিয়মিত পাখি দেখতে বনবাদাড়ে ঘুরে বেড়ান। পাখিদের নিয়ে কবিতা, ছড়া, গল্প ও প্রবন্ধ লেখেন। কেউ পাখির সুন্দর ছবি আঁকেন। তবে পাখি দেখতে হলে সুন্দর একটা মন থাকতে হবে। আর বনবাদাড়ে ভ্রমণের কষ্টকে জয় করতে হবে।
ছেলেবেলা থেকেই পাখি দেখা আমার শখ ও নেশা। বরিশাল শহরের কাছে শায়েস্তাবাদের হবিনগর গ্রামে আমার বেড়ে ওঠা। ছেলেবেলায় কোনো পাখিপ্রেমীর সঙ্গে দেখা হয়নি। দেখা হয়েছে অনেক পাখিশিকারির সঙ্গে, যাঁরা এয়ারগান দিয়ে ঘুঘু, বক ও বুনো হাঁস শিকার করতেন। গ্রামের দুরন্ত সে সময়ে পাখি দেখার জন্য কয়েকজন সঙ্গী জোটাতে পেরেছিলাম।
নব্বইয়ের দশকের প্রথম দিকে হবিনগর গ্রামে এক ঝাঁক বাংলা শকুন এসেছিল। সংখ্যায় প্রায় ১০০। পুরো গ্রামে আলোড়ন তৈরি হলো। আমরা কয়েকজন মিলে আড়িয়াল খাঁ নদে নৌকা নিয়ে শকুন দেখতে গিয়েছিলাম। খুব কাছ থেকে বাংলা শকুন দেখেছিলাম। বিশাল দেহ, ঠোঁট দেখে আমাদের ভয় লাগল। আমরা দ্রুতই নৌকা চালিয়ে একটু দূরে চলে গেলাম।
গ্রামের পাখি দেখতে দেখতে আমরা নাওয়া-খাওয়া ভুলে যেতাম। এমন নেশাকে আর ছাড়তে পারিনি।
ছেলেবেলায় হবিনগর গ্রামে পাখি দেখার পর বাংলাদেশের যে গ্রামটিতে শৈশবের মতো নেশাতুর হয়ে পাখি দেখেছি, সেই গ্রামটি হলো পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলার কাজীপাড়া। ২০০৯ সালে হেমন্তের এক ভোররাতে মহানন্দা নদীর তীরবর্তী গ্রামটিতে প্রথম যাই। সঙ্গী ছিলেন পাখিবিশেষজ্ঞ রোনাল্ড হালদার, আলোকচিত্রী জামীরুদ্দিন ফয়সাল, সি এম রেজা ভাইসহ আরও কয়েকজন।
বাংলাদেশের বিখ্যাত যত পাখিবিশেষজ্ঞ আছেন, তাঁদের প্রায় সবারই এই কাজীপাড়ায় পদচারণ ঘটেছে। ড. রেজা খান ও ইনাম আল হক হলেন প্রথম দিকের পাখি পর্যবেক্ষক, যাঁরা আমাদের কাজীপাড়ায় যেতে উৎসাহিত করেছেন।
তেঁতুলিয়ার কাজীপাড়ায় প্রধানত একটি পাখি দেখার জন্যই যাওয়া হতো। সেটি হলো শেখ ফরিদ বা কালা তিতির। বাংলাদেশের অতি বিপন্ন একটি মাঠের পাখি। তিন বা চার দশক ধরে কাজীপাড়াতেই কেবল শেখ ফরিদকে নিয়মিত দেখা যায়।
তবে সাম্প্রতিক সময়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও ঠাকুরগাঁওয়ের ভারত সীমান্তসংলগ্ন গ্রামে কালা তিতির দেখা গেছে। কাজীপাড়ার বুনো ঝোপ অনেকটাই বিলীন হয়ে গেছে। ঝোপঝাড় পুড়িয়ে সেখানে চা-বাগান ও ফলের বাগান হয়েছে। শেখ ফরিদের আবাস প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে। তবে ভারত সীমান্তের দিকে কিছু ঝোপঝাড় টিকে আছে বলে শেখ ফরিদ এখনো দেখা যায় তেঁতুলিয়ার কাজীপাড়ার মাঠঘাটে।
২০০৯ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত অসংখ্যবার তেঁতুলিয়ায় পাখি দেখতে গিয়েছি। প্রতিবারই শেখ ফরিদের সঙ্গে দেখা হয়েছে। প্রায় সাত বছর ধরে তেঁতুলিয়ায় যাওয়া হয়নি। তবে দেশে এখন প্রচুর পাখি ও বন্য প্রাণী আলোকচিত্রী রয়েছেন। প্রতিবছরই তাঁরা সেখানে যাচ্ছেন শেখ ফরিদকে দেখতে। ২০২২ সালেও তেঁতুলিয়ায় পাখিটি দেখা গেছে। কাজীপাড়ায় দেখা মেলে ১৩৭ প্রজাতির পাখি।
পাখি গবেষকেরা এখানে কিছু বিরল প্রজাতির আবাসিক ও পরিযায়ী পাখির দেখা পেয়েছেন। এদের মধ্যে রয়েছে মেটেচাঁদি চড়ুইভরত বা ধুলাচাটা, নদী টিটি, ধলাচোখ ছাতারে, মেটে ঝারফিদ্দা, হলদেগাল টিটি, বুনো কোয়েল, পাতি পাপিয়া, গুটি ইগল, মেটেবুক প্রিনা, পাকড়া চুটকি, কালোপাশ চুটকি, উত্তরে টিটি, গাঙ নাকুটি ইত্যাদি। বিশ্বব্যাপী পাখিদেখিয়েদের অনলাইন ডেটাবেজ ই-বার্ড সূত্রে এমন তথ্য জানা গেছে।
কাজীপাড়ার পাখি সংরক্ষণে অনেকেই এখন এগিয়ে আসছেন। কাজীপাড়ার পাখিদের মতো সেই গ্রামের মানুষদেরও ভুলে থাকা সম্ভব নয়। কারণ, পাখি দেখার সময় তাঁদের সাহায্য, ভালোবাসাও ছিল অফুরান। তাঁদের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে কাজীপাড়ার পাখিরা টিকে থাকুক অনন্তকাল।
সৌরভ মাহমুদ, প্রকৃতিবিষয়ক লেখক