আমাদের দ্রুততম পাখিরা

ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জে গাছের ডালে একটি স্ত্রী পোকামারা বাজছবি: লেখক

বিরল ও দুর্লভ পাখির সন্ধানে দুই দিন ধরে রাজশাহীর পদ্মার চরে ঘুরছি। দ্বিতীয় দিন দুপুরে দেশের সবচেয়ে উঁচু পাখি লোহারজঙ্গের ছবি তুলে নবগঙ্গা থেকে ফিরছি। হাড়ুপুর পার হয়ে বুলনপুরের কাছাকাছি আসতেই আচমকা একটি ছোট বাজপাখি চরের ওপর উড়ন্ত পায়রার ঝাঁকে উল্কার গতিতে আক্রমণ করে একটি সাদা-কালো পায়রাকে নখে গেঁথে নিল। এরপর ওর ধারালো চঞ্চু দিয়ে পায়রাটির ঘাড় মটকে দিল।

এ রকম অবস্থার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। উড়ন্ত পায়রার নির্মম হত্যাকাণ্ড মনকে ব্যথিত করলেও মেনে নিলাম, কারণ এটাই প্রকৃতির নিয়ম। শিকার শেষে পাখিটি চরে নেমে মরা পায়রাটিকে পায়ে আটকে ধরে চঞ্চু দিয়ে পালক ছাড়িয়ে মাংস খেতে থাকল। আমাদের নৌকা ওর কাছাকাছি আসতেই বিরক্ত হয়ে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে শিকারসহ উড়ে গিয়ে খানিকটা দূরে বসে খেতে লাগল।

২০১৬ সালের ৩০ জানুয়ারির ঘটনা এটি। এই ছোট বাজপাখিটিকে প্রথম দেখি ২০১৬ সালের ৭ জানুয়ারি হাতিয়ার নিঝুম দ্বীপে। পৃথিবীর দ্রুততম প্রাণী উল্কাগতির এই পাখিটির নাম বহেরি বাজ। শিকার ধরতে ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ৩৮৯ কিলোমিটার বেগে উড়তে সক্ষম।

বহেরি বাজসহ ছোট বাজপাখিগুলো শ্যেন বা শাহিন (ফ্যালকন) নামে পরিচিত। একসময় ওরা বাজ-ইগল-শকুনদের সঙ্গে একই বর্গ ফ্যালকনিফরমেসের অন্তর্ভুক্ত ছিল। কিন্তু ২০০৮ সালে ডিএনএ পরীক্ষায় দেখা গেল, ওরা বাজ-ইগল-শকুনদের চেয়ে বরং তোতা-টিয়া-চড়ুই-শালিকদেরই কাছাকাছি। তাই বাজ-ইগল-শকুনদের জন্য নতুন বর্গ অ্যাক্সিপিট্রিফরমেস তৈরি হলো।

আর শাহিনরা (ফ্যালকন, ফ্যালকোনেট, কারাকারা ও ফরেস্ট ফ্যালকন) রয়ে গেল পুরোনো বর্গ ফ্যালকনিফরমেসের একমাত্র গোত্র ফ্যালকনিডিতে। শাহিনরা বাজ-ইগল-শকুনদের মতো শিকারি হলেও অত্যন্ত দ্রুতগতিসম্পন্ন এবং ওদের ডানার পালক লম্বা। শিকার ধরে তাকে পায়ের নখের পরিবর্তে বড়শির মতো বাঁকা চঞ্চুর ভেতরে থাকা ধারালো দাঁত দুটি দিয়ে মারে। বিশ্বে শাহিন বর্গের মোট প্রজাতিসংখ্যা ৬৬ এবং এ দেশে ১০। মাত্র ৩৫ গ্রাম ওজনের কালো-পাছা ফ্যালকনেট থেকে ১ হাজার ৭৩৫ গ্রাম ওজনের গিরফ্যালকনরা শাহিন বর্গের সদস্য।

ওদের দৃষ্টিশক্তি অত্যন্ত তীক্ষ্ণ। পৃথিবীর দ্রুততম পাখি এই গোত্রেরই সদস্য। স্ত্রী পুরুষদের চেয়ে আকারে বড়। এ দেশের পক্ষী তালিকার ১০ প্রজাতির শাহিনের মধ্যে ছোট বাজ, ইউরেশীয় বাজ, মারলিন, ধুতার ও সাকের বাজ দেখার সৌভাগ্য হয়নি। বাকি যে পাঁচ প্রজাতির দেখা পেয়েছি, তাদের সংক্ষিপ্ত পরিচয় এখানে তুলে ধরছি।

ঢাকার সোবহানবাগে মোবাইল টাওয়ারে তুরমতি বাজ
ছবি: লেখক

১. বহেরি বাজ (পেরেগ্রিন ফ্যালকন): এ দেশের দুর্লভ শীতের পরিযায়ী পাখিটি আগুনে বাজ বা বাজ বাউরি (পশ্চিমবঙ্গ) নামেও পরিচিত। মূল আবাস উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা, ইউরোপ, আফ্রিকা, এশিয়া ও অস্ট্রেলিয়া। দেহের দৈর্ঘ্য ৩৪ থেকে ৫৮ সেন্টিমিটার ও ওজন ৫৫০ থেকে ১ হাজার ৫০০ গ্রাম।

২. পোকামারা (কমন ক্রেস্টেল): এ দেশের বহুল দৃশ্যমান শীতের পরিযায়ী পাখিটির অন্য নাম সাপখাওরি/ছোট বাজ। মূল আবাস ইউরেশিয়া, দক্ষিণ এশিয়া ও আফ্রিকা।

৩. তুরমতি বাজ (রেড-নেকড ফ্যালকন): দুর্লভ আবাসিক পাখিটি শিরেল বাজ নামেও পরিচিত। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়া এবং আফ্রিকায় দেখা যায়। বিশ্বে এটি প্রায় শঙ্কাগ্রস্ত হিসেবে বিবেচিত।

৪. লালপা তুরমতি (আমুর ফ্যালকন): এ দেশের পন্থ-পরিযায়ী পাখিটির মূল আবাস দক্ষিণ-পূর্ব আফ্রিকা এবং দক্ষিণ ও উত্তর-পূর্ব এশিয়া। এসব দেশ থেকে অন্য দেশে পরিযায়নের সময় হেমন্তে এবং পরিযায়ন শেষে বসন্তে স্বল্প সময়ের জন্য এ দেশে বিশ্রাম নিতে নামে।

৫. লগ্গর বাজ (লগ্গর ফ্যালকন): বিরল ও সংকটাপন্ন আবাসিক পাখিটি উত্তর-পূর্ব আফগানিস্তান, পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চল থেকে ভারত ও নেপালের প্রায় সর্বত্র হয়ে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল এবং পশ্চিম মিয়ানমার পর্যন্ত বিস্তৃত।

মূলত উন্মুক্ত এলাকা, যেমন মাঠ, চরাঞ্চল, তৃণভূমি ইত্যাদি পছন্দ। কোনো কোনো প্রজাতিকে শহরেও দেখা যায়। একাকী বা জোড়ায় থাকে। মূলত অন্য পাখি শিকার করে খায়। সারা জীবনের জন্য জোড় বাঁধে। খাড়া পর্বতের গায়ে, উঁচু গাছ, দালান বা টাওয়ারে ডালপালা, ঘাস ও পশম দিয়ে মাচার মতো বাসা বানায়। প্রজাতিভেদে তিন থেকে সাতটি ডিম পাড়ে। স্ত্রী একাই তা দেয়। ডিম ফোটে ২৮ থেকে ৩৬ দিনে। ছানারা ২৮ থেকে ৪৯ দিনে উড়তে শেখে। আয়ুষ্কাল পাঁচ থেকে সাত বছর।

  • আ ন ম আমিনুর রহমান, পাখিবন্য প্রাণী চিকিৎসাবিশেষজ্ঞ