দক্ষিণের বৃক্ষ পেলাম উত্তরে

ডাকুর ফল
ছবি: তুহিন ওয়াদুদ

প্রকৃতিবাদী সংগঠন ‘গ্রিন ইকোর’ আমন্ত্রণে গিয়েছিলাম কুড়িগ্রাম শহরে। সেখানকার কালেক্টরেট স্কুল অ্যান্ড কলেজে ১০ হাজার কাঁঠালের চারা বিতরণ কার্যক্রমের উদ্বোধন উপলক্ষে চমৎকার অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল।

অনুষ্ঠান শেষে ফিরছি রংপুর। পথে পথে অনেক চেনা–অচেনা দৃশ্য দেখা হলো। তবে উল্লেখ করার মতো ছিল যত্রতত্র বিপুলসংখ্যক সুপারির চারা ক্রয়-বিক্রয় ও পরিবহনের দৃশ্য। পরে জানতে পারি, এখানে বাণিজ্যিকভাবে সুপারিগাছের চাষ করা হয়। চমৎকৃত হলাম। গত দুই দশকে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে যেখানে সুপারির বন কমছে, সেখানে কুড়িগ্রামে এটি রীতিমতো বাণিজ্যিক পণ্য! দেশের উত্তর জনপদে অজস্র ইউক্যালিপটাসের হতাশাজনক দৃশ্যের বিপরীতে এটি সুসংবাদ বটে। অনেকটা ক্ষতস্থানে প্রলেপের মতো।

সহযাত্রী অধ্যাপক তুহিন ওয়াদুদ, ডা. এহসানুল করিম, ডা. শামিম আরা খান চৌধুরী, সঞ্জয় চৌধুরী প্রমুখের সঙ্গে যখন বিদেশি বৃক্ষের কুফলবিষয়ক আলোচনা তুঙ্গে, তখন তুহিন ওয়াদুদ ড্রাইভারকে গাড়ি থামাতে বললেন। এরশাদ নগরের পাশে থামল গাড়ি। তিনি আমাকে নিয়ে গেলেন একটি গাছের কাছে। জিজ্ঞেস করলেন গাছটির পরিচয়।

প্রায় ১০ মিটার উঁচু গাছটিতে সবুজ রঙের কিছু ফল ঝুলে আছে। সাদা রঙের কিছু ফুলও আছে। ফলের আকৃতি দেখে একবার ভাবলাম অ্যাভোকাডো কি না। কিন্তু গাছটির পাতা অ্যাভোকাডোগাছের পাতার মতো নয়, বরং অনেকটা আমগাছের পাতার মতো। আকাশ–পাতাল ভেবেও গাছটির নাম-পরিচয়ের কোনো কূলকিনারা করা গেল না। তাঁকে আশ্বস্ত করলাম, অচিরেই জানা যাবে গাছটির পরিচয়।

ঢাকায় ফিরে গাছটির নাম-ঠিকুজি খুঁজে বের করলাম। স্থানীয়ভাবে ডাবুর বা ডাকুর নামে পরিচিত। ইংরেজি নাম ‘সুইসাইড ট্রি’ বা ‘সি ম্যাংগো’। মনে পড়ল, পাঁচ-ছয় বছর আগে খুলনায় একটি বাগানে দু-তিন মিটার উঁচু ফুলসমেত একটি গাছ দেখেছিলাম। বাগানমালিক গাছটিকে ডাকুর নামেই পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন।

গাছটি প্রায় ১২ মিটার পর্যন্ত উঁচু হতে পারে। ছোট শাখাগুলো চক্রাকার। পাতা মসৃণ, পাতার বৃন্ত দেড় থেকে ৪ সেন্টিমিটার লম্বা, পাতার ফলক ১৮ সেন্টিমিটার, বল্লমাকার, মাঝামাঝি স্থানের ওপরে চওড়া, নিচের দিকে শীর্ষ সূক্ষ্ম এবং ক্রমান্বয়ে সরু। পাঁচ পাপড়ির ফুলগুলো মসৃণ ও সাদা রঙের। ফুল ও ফলের মৌসুম মার্চ থেকে জুলাই মাস।

পাকা ফল লাল, মসৃণ ও গোলাকার। কিছু নির্দিষ্ট প্রজাতির পাখি খায়। এর মূল অংশে অত্যন্ত বিষাক্ত একটি বীজ রয়েছে। এই চরম বিষের কারণে ডাকুর ‘সুইসাইড ট্রি’ বা ‘আত্মঘাতী গাছ’ নামে পরিচিত। ভারতে ১৯৮৯ থেকে ১৯৯৯ সালের মধ্যে প্রায় ৫০০ জনের মৃত্যু ঘটেছে এই গাছের ফল খেয়ে।

ডাকুর ফুল
ছবি: লেখক

ডাকুরের বৈজ্ঞানিক নাম Cerbera odollam। এটি প্রধানত উপকূলীয় লবণাক্ত অঞ্চলের বৃক্ষ। বাংলাদেশে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের উপকূলীয় অঞ্চলে জন্মায়। এ ছাড়া শ্রীলঙ্কা, ভারত, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার উপকূলীয় অঞ্চলে সহজলভ্য। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের এই বৃক্ষ কীভাবে উত্তরাঞ্চলে এসে পৌঁছাল, তা এক রহস্য বটে। গাছটি এখানে কে যে কখন লাগিয়েছেন, তা এখন আর জানা যায় না।

এই গাছের বীজের তেল চর্মরোগ ও প্রদাহজনিত রোগের জন্য কার্যকর। মাথার উকুন মারতে চুলে লাগানোর চল আছে। বীজ থেকে নিষ্কাশিত গ্লাইকোসাইড হৃদ্‌যন্ত্র সচল রাখতে সাহায্য করে। কাণ্ডের ছাল বা পাতা মাঝেমধ্যে শোধনকারী হিসেবে ব্যবহার করা হয়। তবে উচ্চ বিষাক্ততার কারণে এসব ব্যবহারে কঠোর সতর্কতা অবলম্বন করা আবশ্যক।

  • মোকারম হোসেন, প্রকৃতি পরিবেশবিষয়ক লেখক