ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দে রে

পাখার পালক কাটা সেই শিকারি বকটি
ছবি: রাশেদ বিশ্বাস

আটটি সাদা বক উড়ে যাচ্ছে ছোট জলাভূমিটার ওপর দিয়ে। ওদের নজর পড়ল নিচের দিকে—জাতভাই একটি বক একাকী চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে, পানি ওখানে ওটার হাঁটুসমান। আশপাশে চার-পাঁচটা পুঁটিমাছ পিঠ ভাসিয়ে তড়পাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে শূন্যে পাখার কড়া ব্রেক কষে ও ডানা গুটিয়ে দ্রুতই নেমে এসে দাঁড়াল চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা একাকী বকটির পাশে। পুঁটিমাছ দেখে পাগল হওয়া বকগুলোর কয়েকটা গিলল মোট পাঁচটি ‘বড়শি-টোপ’, অন্য তিনটির পা পড়ল পানির তলায় পেতে রাখা জাঁতিকলের ফাঁদে। এরপর ঠোঁটে বড়শির যন্ত্রণা আর পায়ে জাঁতিকলের শক্তিশালী লোহার স্প্রিংয়ের কামড়ে বকগুলো মরণচিৎকার দিয়ে দাপাদাপি-ছটফট করে মুক্তি পেতে চাইল। একাকী বকটি আগের মতোই চুপচাপ দাঁড়ানো। প্রায় পাঁচ মিনিট ফাঁদ থেকে মুক্তি পেতে চেয়ে বকগুলো হয়রান হয়ে নেতিয়ে গেল। একেই বলে ‘ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দেরে’। বক যে কাঁদে—এ রকম ক্ষেত্রে, সেটা সত্যি।

জলাভূমির পাশেই বসে ছিল ‘বক দিয়ে বক শিকারি’ বা ‘টোপ–বক’ শিকারি জিহাদ আলী। ইচ্ছে করেই দেরি করে বকগুলোকে পাকড়াও করতে চলল সে। টোপ-বকটির ওড়ার পালক কেটে ফেলা হয়েছে, পোষ মানানো হয়েছে। মাঠ-বিলে ওটাকে ছেড়ে রাখা হয়। ওটার আশপাশের পানির তলায় কয়েকটি জাঁতিকল পেতে রাখা হয়। পানির তলায় কঞ্চি পুঁতে ও কঞ্চির মাথার শক্ত সুতার মাথার বড়শিতে জ্যান্ত পুঁটিমাছের পিঠ গেঁথে পাতা হয় ‘বড়শি ফাঁদ’। টানটান সুতার জন্য পুঁটিটা পানির ওপরেই থাকে, ছোটাছুটি করে।

এ রকম বড়শি ফাঁদে ব্যাঙের টোপ দিয়ে শামুকভাঙার মতো বড় পাখিও আটকানো সম্ভব। যাহোক, সব ধরনের বকেরই স্বভাব হলো উড়তে উড়তে কোথাও অন্য একটি বককে জলে বসা দেখলে মনে করে খাবার আছে ওখানে। ‘টোপ শিকারি’ বকটির তো পেট ভরাই থাকে, শিকারি জিহাদ আলী ওটার পেট ভরায় বাড়িতে বসেই। জিহাদ ওটাকে পুষেছে বাচ্চা অবস্থা থেকে, ট্রেনিং দিয়ে পাকা শিকারি বানিয়েছে।

বকটি হলো আমাদের আবাসিক পাখি বড় সাদা বক। দাঁড়বক, যাঠুয়া বক, সারস বক নামেও পরিচিত। সাতক্ষীরায় পরিচিত গগন ফ্যাড়স ও ঢালিবক নামে। জিহাদের আছে একটি শিকারি পানিকৌড়িও। শিকারপদ্ধতি একই।

এই জিহাদ আলীর খবর জানা ছিল সাতক্ষীরার তালা উপজেলার আগোলঝাড়া গ্রামের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় নিয়োজিত প্রতিষ্ঠান ‘ওয়াইল্ড লাইফ মিশনের’। জিহাদের বাড়ি শ্যামনগর উপজেলার নদিয়া গ্রামে। গত আগস্টের শেষ সপ্তাহের উল্লিখিত ঘটনার দিন ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন ওয়াইল্ড লাইফ মিশনের রাশেদ বিশ্বাস, শেখ মোখলেসুর রহমান, সেলিম শেখ ও ঢাকা বন্য প্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের সদস্য শেখ জসীম। বহু বাগ্‌বিতণ্ডা। জমে গেল লোকজন। থানা-পুলিশ, প্রশাসন ও বন্য প্রাণী আইনের ভয় দেখানোর পর ওখানকার নূরনগর ইউনিয়ন পরিষদের একজন সদস্যের সহযোগিতায় শিকারি বকসহ শিকার করা বকগুলোকে আগোলঝাড়ায় এনে স্থানীয় উদ্ধারকেন্দ্রে রাখলেন। আনলেন পানকৌড়িটাকেও। দু-চার দিনের টুকটাক সেবা ও চিকিৎসায় ফাঁদে পড়া বকগুলো সুস্থ হলো। এরপর উড়ে গেল প্রকৃতিতে। ওগুলোর পা ও ঠোঁট-মুখ যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।

সেই শিকারি বক ও পানকৌড়িটি এখনো মুক্ত অবস্থায় আছে। নতুন পাখা গজাবে হয়তো! হয়তোবা উড়ে যাবে অনেক দূরে।