অনেক গুণের কুলিনজান
কুলিনজান বা কুলানজানের সঙ্গে কুলঞ্জন বা কুলাঞ্জলের পরিচয়গত বিভ্রান্তি রয়েছে। দুটি উদ্ভিদের মধ্যে নামের সূক্ষ্ম এই পার্থক্য আলাদা করতে না পারলে বড় ধরনের বিভ্রাট তৈরি হতে পারে। এই বিভ্রান্তিতে আমিও পড়েছিলাম। পরে বইপুস্তকের শরণাপন্ন হয়ে সঠিক পরিচয় জেনেছি। তবে আমাদের চারপাশে কুলঞ্জন বেশি দেখা গেলেও কুলিনজান বা কুলানজান সে তুলনায় অনেক কম। এই লেখায় আমার পক্ষপাত অপেক্ষাকৃত দুষ্প্রাপ্য বা অপ্রচলিত কুলিনজানের প্রতি। গাছটি ভালোভাবে চেনা গেলে বিভ্রান্তি অনেকটাই কমবে। জিঞ্জিবারেসি পরিবারের এই গাছের ইংরেজি নাম গ্রেটার গালানগাল। কোথাও কোথাও বড় কুলিনজান নামেও পরিচিত।
আকস্মিকভাবে কুলিনজানের দেখা পেয়েছিলাম ঢাকার একটি পাঁচ তারকা হোটেলের সম্মুখ প্রাঙ্গণে। পাতা ও ফুলের গড়ন কিছুটা ব্যতিক্রম হওয়ায় সহজেই চোখে পড়ে গাছটি। তখন অচেনা হিসেবেই ছবি তুলি। পরে নামঠিকুজি খুঁজতে গিয়ে দেখা দেয় বিপত্তি। যার প্রধান কারণ কাছাকাছি নামে বহাল তবিয়তে থাকা আরেকটি গাছ, যা আগেই উল্লেখ করেছি।
কুলিনজান (Alpinia galanga) বহুবর্ষজীবী মোথাযুক্ত বীরুৎ শ্রেণির গাছ। মোথা অনেকটা টিউবের মতো, সুগন্ধযুক্ত, তবে স্বাদে ঝাঁজালো ও তেতো। পত্রল-কাণ্ড ২ থেকে ৩ মিটার লম্বা। পাতা লম্বাকৃতি। পত্রবৃন্ত ৫ থেকে ৭ মিলিমিটার লম্বা, আগায় মঞ্জরি, ৩০ সেন্টিমিটার লম্বা। পুষ্পবিন্যাস অগ্রমুখী, ৩০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত লম্বা, মঞ্জরি অক্ষ রোমশ, অনেক ফুলগুচ্ছ থাকে, প্রতি গুচ্ছে ৩ থেকে ৫টি ফুল দেখা যায়। মঞ্জরিপত্র সাদাটে, ২ সেন্টিমিটার পর্যন্ত লম্বা, ওপরের শাখার দিকে বড়, নিচের দিকে ছোট, ডিম্বাকার, অপরিণত ফুল মুকুলকে আবৃত করে রাখে। ফুল সুগন্ধি, ৩ থেকে ৪ সেন্টিমিটার লম্বা। বৃতি ৬ থেকে ১৩ মিলিমিটার লম্বা, খাটো এবং প্রশস্তভাবে ৩ খণ্ড, ওপরের প্রান্ত রোমশ, সাদা অথবা ফিকে সবুজ। মঞ্জরি-ঢাকনি সাদাটে, পাপড়ি সাদা বা হালকা সবুজ বর্ণের। পরাগদণ্ড দেড় থেকে ২ সেন্টিমিটার লম্বা, পরাগকোষ ৮ থেকে ১০ মিলিমিটার লম্বা ও সমান্তরাল। ফল কমলা-লাল বর্ণের। ফুল ও ফলের মৌসুম জুন মাস।
এ গাছের মোথাকন্দ টনিক হিসেবে এবং পাকস্থলীর শক্তি বাড়াতে কাজে লাগে। এ ছাড়া মোথাকন্দ শক্তিবর্ধক, কফ নির্গমক, বায়ুনাশক ও উত্তেজক। সাধারণত বাতজ্বর, যৌনরোগ, সর্দি, মাথাব্যথা, বহুমূত্র এবং যকৃতের জ্বালাপোড়ায় গাছের বিভিন্ন অংশ ব্যবহার করা হয়। মোথাকন্দ থেকে নিষ্কাশিত সুগন্ধি তেল শিশুদের শ্বাসকষ্টে উপকারী। বীজ ডায়রিয়া ও বমিতে কার্যকর। ইন্দোনেশিয়ায় এটি মসলা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। থাইল্যান্ডে উপাদেয় রান্নায় উৎকৃষ্ট মসলা হিসেবে ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। ফুল খাওয়া যায়। তাজা মোথাকন্দ থেকে সুগন্ধি তেল প্রস্তুত করা হয়।
রাইজোম বা মোথাকন্দ থেকে সহজেই বংশবিস্তার করা যায়। বর্তমানে আবাসস্থল ধ্বংসের কারণে প্রজাতিটি সংকটাপন্ন। সিলেটসহ দেশের কয়েকটি জেলায় দেখা যায়। এ গাছ ভারত, ইন্দো-চীন, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন এবং শ্রীলঙ্কায় সহজলভ্য।
মোকারম হোসেন, প্রকৃতি ও পরিবেশবিষয়ক লেখক