এবার জানুয়ারিতে দুর্যোগপূর্ণ দিন ছিল সবচেয়ে বেশি

ঢাকায় চলতি জানুয়ারি মাসে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক দিন দুর্যোগপূর্ণ বায়ুর মধ্যে কাটিয়েছেন নগরবাসী। এ মাসে মোট ৯ দিন রাজধানীর বায়ুর মান দুর্যোগপূর্ণ ছিল, যা গত সাত বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।

নভেম্বর, ডিসেম্বর, জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি—বছরের এই চার মাস ঢাকার বায়ু বেশি দূষিত থাকে। এর মধ্যে জানুয়ারিতে বায়ুর মান থাকে সবচেয়ে বেশি খারাপ।

বায়ুদূষণের সর্বোচ্চ স্তরকে ‘দুর্যোগপূর্ণ’ বলা হয়। ঢাকায় কত দিন বায়ু দুর্যোগপূর্ণ অবস্থায় থাকে, ২০১৭ সাল থেকে তার হিসাব রাখছে স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস)। তাদের হিসাবে, ২০১৭ সালের জানুয়ারি মাসে বায়ুদূষণে ‘দুর্যোগপূর্ণ’ দিনের সংখ্যা ছিল ৫। ২০১৮ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে এমন দিনের সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ৪, ৪, ৪, ৭ ও ১।

বায়ুদূষণে মারাত্মক স্বাস্থ্যগত প্রভাব আছে। বায়ুদূষণ নগরবাসীকে কতটা ভোগাচ্ছে তা বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে। কিন্তু এ থেকে পরিত্রাণে সরকারি সংস্থাগুলোর কার্যকর কোনো তৎপরতা নেই। এর মধ্যে গত রোববার রাজধানীতে এক সভায় পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন বায়ুদূষণের জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন। সেই সঙ্গে ‘বৃষ্টি হলে দূষণ কমে যাবে’ বলে প্রকৃতি আর ভবিতব্যের কাছে বিষয়টি ছেড়ে দেন তিনি।

প্রকৃতির ওপর ছেড়ে দেওয়ার বিষয়ে বক্তব্য জানতে গতকাল সোমবার মন্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। তবে তাঁর বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি। এদিকে ঢাকায় বৃষ্টিও হয়নি। গতকাল সোমবারও বায়ুর দিক দিয়ে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহর ছিল ঢাকা।

বায়ুর মানের হিসাব

সুইজারল্যান্ডভিত্তিক বায়ুর মান পর্যবেক্ষণকারী প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান আইকিউ এয়ার দূষিত বাতাসের শহরের তালিকা প্রকাশ করে। প্রতিদিনের বাতাসের মান নিয়ে তৈরি করা একিউআই সূচক একটি নির্দিষ্ট শহরের বায়ু কতটুকু নির্মল বা দূষিত, সে সম্পর্কে মানুষকে তথ্য দেয় এবং তাদের কোনো ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হতে পারে কি না, তা জানায়।

একিউআই সূচকে স্কোর (নম্বর) ৫০ বা তার নিচে থাকলে বায়ুর মান ভালো বলে ধরা হয়। স্কোর যত বাড়ে, বায়ুর মান তত খারাপ বলে গণ্য করা হয়। স্কোর ২০১ থেকে ৩০০ হলে বায়ুর মান খুবই অস্বাস্থ্যকর এবং ৩০১ এর বেশি হলে দুর্যোগপূর্ণ অবস্থা বলে ধরা হয়।

ঢাকার ক্ষেত্রে ১৩ জানুয়ারি একিউআই স্কোর ছিল এ মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি, ৪০৪। ২৯ জানুয়ারি পর্যন্ত হিসাবে সর্বশেষ দুর্যোগপূর্ণ দিনটি ছিল ২৭ জানুয়ারি, স্কোর ৩০৪। জানুয়ারি মাসের প্রথম ২৯ দিনে দুর্যোগপূর্ণ ৯ দিনের বাইরে বাকি ২০ দিন বায়ুর মান ছিল খুবই অস্বাস্থ্যকর।

এবার জানুয়ারিতে বেশিসংখ্যক দিন দুর্যোগপূর্ণ থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের চেয়ারম্যান আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, তিন কারণে বায়ুদূষণ আগের চেয়েও বেড়ে গেছে বলে ধারণা তাঁর—১. উন্নয়নকাজের জন্য খোঁড়াখুঁড়ি বেড়ে যাওয়া। ২. পুরোনো যানবাহন ও ডিজেলের ব্যবহার বৃদ্ধি এবং ৩. সার্বিকভাবে যানবাহন চলাচল বেড়ে যাওয়া।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের বায়ুমান গবেষণা কেন্দ্রের হিসাবে, ধুলা ও ধোঁয়া ঢাকার বায়ুদূষণের ক্ষেত্রে ৫০ শতাংশ ভূমিকা রাখে। এ ধুলার বড় উৎস অব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে নির্মাণকাজ, পুরোনো যানবাহনের দূষিত বায়ু। আর ৪০ শতাংশ দূষণের উৎস খড়, কাঠ ও তুষের মতো জৈববস্তুর ধোঁয়া ও সূক্ষ্ম বস্তুকণা।

বাতাসে অতিক্ষুদ্র বস্তুকণার (পিএম ২.৫) উপস্থিতির গ্রহণযোগ্য মান হলো প্রতি ঘনমিটারে ১৫ মাইক্রোগ্রাম। ঢাকার ১০টি এলাকা পর্যবেক্ষণ করে ক্যাপস বলছে, অতিক্ষুদ্র বস্তুকণার গড় উপস্থিতি ৭৩ মাইক্রোগ্রামের বেশি।

কী করছে সরকার

সরকারি সংস্থা পরিবেশ অধিদপ্তরের প্রধান দায়িত্বের একটি বায়ুদূষণ রোধ। পরিবেশ অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, তাদের রূপকল্প (ভিশন) হলো ২০৪১ সালের মধ্যে দূষণমুক্ত বসবাসযোগ্য একটি সুস্থ, সুন্দর ও মডেল বাংলাদেশ গড়ে তোলা। যদিও দূষণ রোধে অধিদপ্তর কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারেনি বলে সমালোচনা রয়েছে।

পরিবেশদূষণের বিষয়টি ২০১৯ সালে আদালতে গড়ায়। ওই বছরের জানুয়ারিতে দূষণ রোধে এক রিটের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট রুলসহ আদেশ দেন। আদালতের নির্দেশের পর পরিবেশ অধিদপ্তর ‘বায়ুদূষণ রোধ নির্দেশিকা’ তৈরি করে। এতে বায়ুদূষণের পেছনে ২২টি কারণ চিহ্নিত করা হয়। এর মধ্যে ছিল ইটভাটা, ফিটনেসবিহীন যানবাহন, নির্মাণকাজের দূষণ, বর্জ্য পোড়ানো, গৃহস্থালির রান্না, আন্তদেশীয় দূষণ ইত্যাদি।

পরিবেশ অধিদপ্তর ও বিআরটিএ (বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ) ২০১৯ সালে জরিপ করে দেখেছিল, ঢাকায় ডিজেলচালিত বাসের মধ্যে ৮৪ শতাংশ ফিটনেসবিহীন।

২০১৯ সালে বায়ুদূষণ নিয়ে রিটকারী ছিলেন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের (এইচআরপিবি) প্রেসিডেন্ট ও আইনজীবী মনজিল মোরসেদ। তিনি গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, রিট করার পর কিছু তোড়জোড় ছিল। এরপর ধীরে ধীরে সব উদ্যোগ স্থবির হয়ে গেছে। তিনি বলেন, ‘ছোটবেলায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়া বানরের লাঠি বেয়ে ওঠার গল্পটাই মনে পড়ে। যতটুকু ওঠে, তার চেয়ে বেশি নামে। বায়ুদূষণ রোধে অবস্থাটা এমনই হয়েছে।’

ভুক্তভোগী শিশুরা

‘ব্রিদিং হেভি: নিউ এভিডেন্স অন এয়ার পলিউশন অ্যান্ড হেলথ ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে গত মাসে বলা হয়, বায়ুদূষণের কারণে সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়ছে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু, বয়স্ক এবং ডায়াবেটিস, হার্ট ও শ্বাসযন্ত্রের রোগীদের ওপর। দূষণের কারণে মানসিক স্বাস্থ্যও খারাপ হচ্ছে।

সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল ও ব্যক্তিগত চেম্বারে এখন শ্বাসতন্ত্রের রোগে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা বেড়ে গেছে বলে জানান বক্ষব্যাধি ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ আবদুস শাকুর খান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বায়ুদূষণে দুই ধরনের নেতিবাচক প্রভাব আছে। প্রথমত, এটি হাঁপানিসহ বিভিন্ন শ্বাসকষ্টের রোগীদের অসুখ বাড়িয়ে দেয়। দ্বিতীয়ত, শিশু, বৃদ্ধ ও সন্তানসম্ভবা নারীদের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে।

ডা. শাকুর খান আরও বলেন, একটি শিশু সবল ফুসফুস নিয়ে জন্মায়। তারপর এই শহরের দূষণ তাদের ফুসফুসকে দিন দিন আক্রান্ত করতে থাকে। এভাবে শিশুরা বায়ুদূষণের ভুক্তভোগী হচ্ছে প্রতিনিয়ত। অথচ এই দূষণে তাদের কোনো দায় নেই।