‘ভূমিকম্প সচেতনতা দিবস’ উপলক্ষে বিশেষ টক শো
ভূমিকম্প বিষয়ে বাড়াতে হবে সচেতনতা, থাকতে হবে প্রস্তুত
আজ ১২ জুন ‘ভূমিকম্প সচেতনতা দিবস’। অন্য অনেক দেশের মতো ভূমিকম্পের ভয়াবহ ঝুঁকিতে আছে বাংলাদেশও। গত কয়েক বছরে বেশ কয়েকবার নানা মাত্রার ভূকম্পন অনুভূত হয়েছে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে। যদিও এগুলোর মাত্রা অনেক কম ছিল। কিন্তু বাংলাদেশে অনেক বড় মাত্রার ভূমিকম্প হতে পারে।
ভূমিকম্প সচেতনতা দিবস উপলক্ষে বিএসআরএমের উদ্যোগে প্রথম আলো ডটকম আয়োজন করে ‘ভূমিকম্প সচেতনতা ও করণীয়’ শীর্ষক তিন পর্বের বিশেষ টক শো। প্রথম আলোর ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশন ও যুব কার্যক্রমের প্রধান সমন্বয়ক মুনির হাসানের সঞ্চালনায় এ পর্বে আলোচক হিসেবে ছিলেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মেহেদী আহম্মদ আনসারী ও অধ্যাপক ড. তাহমীদ মালিক আল-হুসাইনী এবং ভিত্তি স্থপতিবৃন্দ লিমিটেডের প্রিন্সিপাল আর্কিটেক্ট ইকবাল হাবিব।
কয়েক দিন আগে তুরস্কে ভয়াবহ ভূমিকম্পের অভিজ্ঞতা দিয়েই আলোচনা শুরু করেন অধ্যাপক ড. মেহেদী আহম্মদ আনসারী। তিনি বলেন, ‘তুরস্কের ভূমিকম্প ছিল ৭ দশমিক ৮ রিখটার স্কেল। এরপর কিছুদিনের মধ্যে আরেকটি ৭ দশমিক ৫ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছে তুরস্কে। পুরো তুরস্কে ৫১ হাজার লোক মারা গেছেন। আর ৯ হাজার লোক মারা গেছেন সিরিয়াতে। এত মানুষ মারা যাওয়ার বড় কারণ হলো বিল্ডিং নির্মাণের দুর্বলতা; অর্থাৎ বিল্ডিং যেগুলো তৈরি করা হয়েছিল, সেগুলো ভূমিকম্পসহনশীল ছিল না। তুরস্ক আর বাংলাদেশের মধ্যে বড় একটি পার্থক্য হলো, তুরস্কে ২০ থেকে ৩০ বছর পরপর সাত থেকে আট মাত্রার ভূমিকম্প নিয়মিত হয়।
আর আমাদের দেশে ৭ মাত্রায় ভূমিকম্প ১০০ থেকে ১৫০ বছর পরপর হয়। আমাদের দেশের বড় ভূমিকম্পগুলো হয়েছে ১৮৭০ থেকে ১৯৩০ সালের মধ্যে। তবে তুরস্ক আর বাংলাদেশের মধ্যে একটা জিনিসের অনেক মিল রয়েছে। সেটা হলো, বিল্ডিংগুলো নির্মাণের অবকাঠামোগত দুর্বলতা। আর অমিল হলো, বাংলাদেশের তুলনায় তুরস্কে লোকসংখ্যা অনেক কম। তাই বলা যায়, তুরস্কের মাত্রায় যদি আমাদের দেশে কোনো ভূমিকম্প হয়, তাহলে আমাদের দেশের অনেক ক্ষতি হবে। ঢাকা শহরে প্রায় ২১ লাখ বাড়ি আছে। এর মধ্যে ছয় লাখ বাড়ি আছে চারতলার ওপরে। মানুষ আছে প্রায় দুই কোটি। আমাদের প্রস্তুতি নিয়ে আমার ভয় আছে।’ বাংলাদেশে যেকোনো সময় সাত মাত্রার ভূমিকম্প হতে পারে বলে জানান তিনি।
বাড়িঘর বানানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশ জাতীয় বিল্ডিং কোড (বিএসবিসি) নীতিমালা করা হয়েছে। নীতিমালাগুলো মেনে ভবন তৈরি করলে কি ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি থেকে আমরা কিছুটা হলেও রক্ষা পাব?
সঞ্চালক মুনির হাসানের এমন প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক ড. তাহমীদ মালিক আল হুসাইনী বলেন, ‘এই নীতিমালা করা হয়েছে, যাতে আমাদের ভূমিকম্প বা প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষয়ক্ষতি কম হয়। বিএনবিসির কোডে বাংলাদেশকে চারটি অঞ্চলে ভাগ করা হয়েছে। এগুলো ভিন্নমাত্রার ভূমিকম্প জোন। ওই জোন বা অঞ্চলগুলোকে আমরা ঝুঁকিমুক্ত রাখা বা ক্ষতির মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছি। নির্দিষ্ট অঞ্চলগুলোর জন্য আমরা আলাদা আলাদা নকশা করছি। এটার উদ্দেশ্য হচ্ছে, যদি নির্দিষ্ট মাত্রার ভূমিকম্প হয়, তাহলে যেন ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কম হয়। তবে ভূমিকম্প হলে শতভাগ রক্ষা করার জন্য আমরা নকশা করি না। সেটা সম্ভবও নয়। আমাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে, বিল্ডিংটা যেন ভেঙে না পড়ে বা ক্ষতি কম হয়।’
ভূমিকম্পে আমার বিল্ডিংটি রক্ষা পাবে কীভাবে, বিষয়টি মাথায় রেখে কি বিল্ডিংয়ের ডিজাইন করা হয়?
মুনির হাসানের এমন প্রশ্নের জবাবে স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, ‘অনেক প্রতিকূলতার মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান। আমাদের অনেকগুলো বিষয় মাথায় রেখে নগরের জন্য পরিকল্পনা করতে হয়, ভবনের জন্য নকশা তৈরি করতে হয়। ঢাকা শহরে যত বাড়ি আছে এর বেশির ভাগের নির্মাণের সঙ্গে কোনো প্রকৌশলী যুক্ত নন। এর মধ্যে আবার রাজউকের হিসাবমতে, ৯০ থেকে ৯২ ভাগ বাড়ি অনুমোদিত নকশার বাইরে গিয়ে নির্মাণ করেছে। এ রকম একটা ভয়াবহতা আমাদের চিন্তা বাড়িয়ে দেয় বহুগুণ।
একই সঙ্গে আমরা কিন্তু দিন দিন নগরগুলো আরও বেশি বসবাসের অনুপযোগী হিসেবে গড়ে তুলছি। সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হলো, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভূমিকম্প অধ্যয়ন বিভাগে পড়ুয়া একজন শিক্ষার্থী যখন ভূমিকম্প হয়, তখন সে জানালা দিয়ে লাফ দেয়। তাহলে আমাদের বুঝতে হবে, সাধারণ মানুষের মধ্যেও ভূমিকম্প বিষয়ে সচেতনতা ও করণীয়-বিষয়ক কার্যক্রমে আমরা কতটা পিছিয়ে আছি। এ ব্যাপারে আমাদের অবহেলা রয়েছে এবং প্রাসঙ্গিকভাবে নির্বিকার সরকারি-বেসরকারি-সংশ্লিষ্ট সংস্থা বা গোষ্ঠী এবং পরিবার ও ব্যক্তিগতভাবে বটেই। প্রস্তুতি থাকলে আমরা ভূমিকম্পকে ভালোভাবে মোকাবিলা করতে পারব। আমাদের প্রস্তুতি নেওয়ার সামর্থ্য রয়েছে, কিন্তু ভূমিকম্প প্রতিরোধ করার সামর্থ্য নেই। তাই এ বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে এবং সে মোতাবেক প্রস্তুতি নিতে হবে সবার আগে।’