অচেনা ইগলের কাছাকাছি
মাত্র ২০ হাত দূর থেকে একটি বিরল ইগল দেখলাম পদ্মায়। ইগলটি আমার কাছে নানা কারণে প্রিয়। পৃথিবীতে এই একটিমাত্র ইগল আছে, যারা মাটিতে বাসা করে বাচ্চা ফোটানোর জন্য। এই ইগল দীর্ঘ পথ পরিযায়ন করে। মূলত রাশিয়া, মঙ্গোলিয়া, চীন, কাজাখস্তান ও কিরগিজস্তান অঞ্চলে এরা প্রজননকাল কাটায়। শীতে এরা আমাদের অঞ্চলে আসে খাবারের সন্ধানে। অসাধারণ সৌন্দর্য আর বৈচিত্র্যের এই ইগলের নাম নেপালি ইগল। ইংরেজিতে বলে স্টেপ ইগল।
প্রতি শীতেই আমি পদ্মা বন্য প্রাণী অভয়ারণ্যে যাই পাখি দেখতে। মূলত ঘাসপাখিই এই এলাকায় মূল আকর্ষণ। এবার গেলাম শিকারি পাখির টানে। গত ২৮ ডিসেম্বরের ঘটনা। ছুটির দিনের শীতের সকালে রাস্তায় কোনো যানজট নেই। গাড়ি নিয়ে এক টানে সকাল নয়টার আগে পৌঁছালাম মাওয়া ঘাটে। কাশেম মাঝিকে পেয়ে গেলাম পুরোনো লঞ্চঘাটে। চার ঘণ্টার জন্য তাঁর নৌকায় ঘোরার পরিকল্পনা করলাম। যতক্ষণ রোদ পাওয়া যায়, ততক্ষণ শিকারি পাখিরা সক্রিয় বেশি থাকে।
পদ্মা অভয়ারণ্যে যে চরগুলো জেগে উঠেছে, সেখানে সুন্দর ঘাসবন হয়েছে। একদল মানুষ এগুলো নৌকা বোঝাই করে কেটে নিয়ে যাচ্ছে। তারা জানেই না কী ক্ষতি তারা করছে! পদ্মার এ ভ্রমণযাত্রায় প্রথম চরেই পেয়ে গেলাম একটি শিকারি পাখি। নাম লম্বাপা তিশাবাজ। দূর থেকে পাখিটির ছবিও ওঠালাম। দূরে বেশ কিছু জেলেকে মাছ ধরতে দেখলাম। বাঁশের খুঁটির ওপর বসে আছে তিনটি ধুপনি বক। এরই মধ্যে আমার সঙ্গী সাহাদত বলে উঠলেন প্রেরিগ্রিন শাহিনের কথা। শিকারের আশায় বাঁশের খুঁটিতে বসে ছিল। পৃথিবীর সবচেয়ে দ্রুতগতির শিকারি পাখি এটি। তার উড়ে যাওয়ার ভঙ্গি দেখে সত্যিই অভিভূত হলাম।
নূর বয়াতি চরে একদল কালা চিলের দেখা পেলাম। সহজে দেখা যায় বলে এই পাখির প্রতি আমাদের আগ্রহ কম। চরে নামতে গিয়েই দেখলাম তিনটি চিল বিশাল দেহী এক ইগলকে তাড়া করার চেষ্টা করছে। কিন্তু ইগলটি খুব বেশি ভ্রুক্ষেপ করছে না। বালুচরে উড়ে এসে বসলে আমরাও তার দিকে এগোতে থাকলাম। যখন চিনতে পারলাম এটি নেপালি ইগল, আমাদের সবার মনটা ভরে গেল। আমার ছেলে-মেয়ে প্রথমবার দেখল এ রকম একটি বিরল ইগল। ইগলটি আমাদের অনেকক্ষণ সময় দিল। প্রায় ২০ মিনিট। ছবি তুলে আমরা ফিরে এলাম নৌকায়। এরপর দেখলাম একসঙ্গে ৪-৫টি চিল তাকে বিরক্ত করছে। তাদের আচরণ দেখে মনে হলো এই চিলগুলোর নিজস্ব চরে ভিনদেশি কেউ দখল করার জন্য আসছে।
নৌকায় ফিরতে না ফিরতেই ইগলটিকে দেখলাম একদম আমাদের ওপর। নেপালি ইগলের দেখা এভাবে পাব, ভাবতেই পারিনি। ইগলটি বিশ্বব্যাপী বিপন্ন ইগল। আমার মঙ্গোলিয়ান বন্ধু ‘বাটমুখ’ এই ইগলের ওপর দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করছেন বিধায় এই পাখির খবর আমার জানা। গোটা পৃথিবীতে ৫০ হাজারের মতো প্রজননক্ষম ইগল টিকে আছে। প্রজননকাল শেষে এরা পরিযায়ন করে এশিয়ার বিভিন্ন দেশে। দক্ষিণ আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলেও এই ইগল যায় শীতের সময়। এ ছাড়া আরবের বিভিন্ন দেশসহ মধ্যপ্রাচ্যেও শীতে ভ্রমণ করে। একটি ইগল তার পরিযায়ন মৌসুমে প্রায় ৮ হাজার কিলোমিটার ভ্রমণ করার তথ্য আছে।
নেপালি ইগলের পরিযায়ন পথে অনেক অসুবিধাও হয়। বিশেষ করে বাচ্চা পাখিদের বেলায়। এদের শিকার ধরার অভ্যাস থাকে না বললেই চলে। এমনকি দীর্ঘ ভ্রমণক্লান্তিতে অনেক সময় ইগল মাটিতে পড়ে যায় এবং উড়তে পারে না। ২০১৮ সালে এ রকম একটি ইগল আমি পেয়েছিলাম পদ্মায়। পরে দুই মাস খাবার খাইয়ে সুস্থ করে পায়ে রিং পরিয়ে পাখিটিকে ছেড়ে দিয়েছিলাম।
ঢাকা থেকে মাওয়ার পদ্মা অভয়ারণ্য খুব বেশি দূরে নয়। ছুটির দিনে যে কেউ বন্ধু আর পরিবার নিয়ে পাখি দেখতে যেতে পারেন। একটি বিরল পাখি পেয়ে গেলে সেটি হবে বোনাস। সরকারিভাবে পদ্মা অভয়ারণ্যটির আরও যত্নœ নেওয়া জরুরি। স্থানীয় বেশির ভাগ জেলে ও মানুষ জানেনই এই অভয়ারণ্যের কথা। আশা করি, ঢাকার অদূরে এই বন্য প্রাণী অভয়ারণ্য সব প্রাণীর জন্য একটি প্রকৃত বিচরণস্থল হবে।
সীমান্ত দীপু, বন্য প্রাণী গবেষক