বিরল গাছ জয়ন্তী

টাঙ্গাইলের সখীপুরে কবি নজরুল পার্কে ফোটা জয়ন্তী ফুল
ছবি: মো. ছদরুল আলম

প্রায় ১২-১৩ বছর আগের কথা। হাঁটুর ব্যথায় খুব কষ্ট পাচ্ছিলাম। হাঁটতেও অসুবিধা। জামালপুর হর্টিকালচার সেন্টারের একজন কর্মকর্তা শুনে বললেন, সেন্টার থেকে রোকনুজ্জামান নামে একজন কর্মী প্রতি সপ্তাহে একজন মন্ত্রীর বাসায় জয়ন্তী গাছের এক ব্যাগ করে পাতা দিয়ে আসে, মন্ত্রী মহোদয়েরও হাঁটুব্যথা। তিনি এই পাতা বেটে তা ব্যথার জায়গায় লাগিয়ে নাকি ব্যথার উপকার পান।

কী আর করা! ওষুধে যখন কাজ হচ্ছে না, অগত্যা কবিরাজি ধরলাম। তাঁকে অনুরোধ করলাম, ঢাকায় আসার সময় আমার জন্যও যেন জয়ন্তীগাছের কিছু পাতা নিয়ে আসে। ফ্রিজে সে পাতা রেখে রেখে কিছুদিন সেভাবে পাতা বেটে কাইয়ের মতো করে ব্যথা জায়গায় পট্টির মতো লেপে দিয়ে রাখলাম।

খানিকক্ষণ বাদে শুকিয়ে গেলে তা ধুয়ে ফেললাম। আশ্চর্যজনক ফল পেলাম। ব্যথা কমে গেল কয়েক দিনের মধ্যেই। আমিও হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। পাতা দেখার পর সেদিন থেকে গাছটির সন্ধানে ছিলাম। কিন্তু বিরল গাছ বলে তার দেখা পাইনি।

অবশেষে এ বছর ফেব্রুয়ারিতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নিসর্গপ্রেমী উদ্ভিদবিদ আবদুর রহিমের কাছ থেকে জয়ন্তীর একটি ছোট চারা উপহার পেলাম। তিনি সেটি সংগ্রহ করেছেন নাটোরের খোলাবাড়িয়া ঔষধি গ্রাম থেকে। এ গাছের সন্ধান পেলে আমাকে একসময় জানাতে তাঁকেও অনুরোধ করেছিলাম।

শুধু সন্ধান নয়, এবার একটা জ্যান্ত চারাই এনে হাজির করলেন তিনি। উচ্ছ্বসিত হয়ে সেই উদ্ভিদকন্যাকে নিয়ে এলাম। কিন্তু ঢাকায় কোথায় তাঁকে লালন-পালন করব? তাই নিয়ে গেলাম টাঙ্গাইলের সখীপুরে যাদবপুর গ্রামে কবি নজরুল পার্কে। সেখানে সবে কিছু গাছপালা লাগানো শুরু করেছি। ওখানেই লাগিয়ে দিলাম ছোট্ট চারাটি। দেখতে দেখতে সে ডাঙর হয়ে উঠল, কয়েক মাস যেতেই আমার মাথা ছাড়িয়ে গেল। এত তাড়াতাড়ি গাছটা যে এত বড় হয়ে উঠবে, তা ভাবিনি। দেখে সন্দেহ হলো, সে কি আসলে জয়ন্তী না ধঞ্চেগাছ? অবশেষে বর্ষায় একটা ডালে কয়েকটা হলদে ফুল ফুটল। এরপর তা দেখে নিশ্চিত হলাম।

জয়ন্তীর সংস্কৃত নাম না হয় জয়ন্তিকা মেনে নিলাম, কিন্তু আয়ুর্বেদিক নাম কী করে নাদেয়ী হয়ে উঠল, সেটি এক রহস্য বটে! এ বিষয়ে একটি কাহিনি বা আদিবিশ্বাস আছে। কাহিনিটি হলো, ধারা নদীর অধিপতি ভোজরাজের প্রচণ্ড মাথাব্যথা, কিছুতেই সারছে না। রেগে রাজার নির্দেশে তাঁর রাজ্যে সব চিকিৎসকের প্রবেশ নিষিদ্ধ করে দিলেন রাজা। দেবলোক বিচলিত, মর্ত্যে আয়ুর্বেদের কি তাহলে কোনো চিহ্ন থাকবে না? ছদ্মবেশে অশ্বিনীকুমার যুগল এলেন দেবলোক থেকে মর্ত্যে।

রাজপ্রাসাদে উপস্থিত হয়ে রাজাকে পরীক্ষা করে বললেন, নদীতে স্নানের সময় জল দিয়ে রাজা নাসারন্ধ্র ধুতে গেলে একটা ক্ষুদ্র মাছ নাকের ফুটো দিয়ে ঢুকে পড়ে এই মাথাব্যথা ঘটিয়েছে। অতএব ফুলের মধ্যে অচেতনকর ভেষজচূর্ণ শুকিয়ে রাজাকে শুঁকালে রাজা অচেতন হবেন। তখন তাঁর মাথার আবরণটি খুলে মাছটা বের করে দিলে রাজা সুস্থ হবেন। সেটি করার পর রাজা সুস্থ হলেন।

সুস্থ হয়ে রাজা পথ্যের কথা জানতে চাইলেন। তখন অশ্বিনীকুমার যুগল বললেন, শরৎ ও বসন্তকালে নদ–নদীর জল ভালো না। তাই সে সময় নাদেয়ী ব্যবহার করা শুভ। এই নাদেয়ী হলো জয়ন্তী। নদীর তীরে জন্মে বলেই ওর নাম নাদেয়ী। ফ্যাবেসি গোত্রের তেঁতুলপাতার মতো পাতার ঝোপালো এ গাছের উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম Sesbania sesban

জয়ন্তীগাছের দেখা এ দেশে সহজে পাওয়া যায় না। অথচ হিন্দুদের দুর্গাপূজায় জয়ন্তীগাছের ডাল লাগবেই। দুর্গাপূজায় নবপত্রিকা বা কলাবউ বানাতে নয়টি গাছ লাগে। এই নয়টি গাছের আটটি সুলভ হলেও জয়ন্তীগাছ সুলভ নয়। সেটা আসে কোথা থেকে? সেটার অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানলাম, বানিয়াতি দোকানে তা পাওয়া যায়। পূজার অন্যান্য উপকরণের সঙ্গে দোকানিরা জয়ন্তীর শুকনো ডাল গছিয়ে দেন। শুকনো ডাল দেখে অবশ্য চেনার উপায় থাকে না যে তা প্রকৃত জয়ন্তীগাছের ডাল কি না। সবই বিশ্বাসের ব্যাপার! এত যার গুণ ও প্রয়োজন, সে গাছটি বিলুপ্তির আগেই তা সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।

  • মৃত্যুঞ্জয় রায়, কৃষিবিদপ্রকৃতিবিষয়ক লেখক