পাহাড়ি সবজি কানাইডিঙ্গা 

কানাইডিঙ্গা ফল ও ফুল শত বছর ধরে সবজি হিসেবে খেয়ে আসছেন পাহাড়িরা
ছবি:সুপ্রিয় চাকমা

বুনো গাছ কানাইডিঙ্গা। এর গুচ্ছবদ্ধ ফুল বেশ বড়, ঈষৎ হলুদ-বেগুনি রঙের। এটি নিশিপুষ্প। তরবারির মতো দেখতে দীর্ঘতম ফলের জন্যও বিখ্যাত গাছটি। এই কানাইডিঙ্গার ফুল ও ফল পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত পাহাড়িদের জনপ্রিয় সবজি। মনে করা হয়, শুধু সবজি হিসেবেই নয়, কানাইডিঙ্গা ফল ভরপুর নানা ঔষধি গুণে।

পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রাকৃতিক বনে গজিয়ে ওঠা এই কানাইডিঙ্গা গাছের বেশ কদর পাহাড়িদের কাছে। অবশ্য পাহাড়িরা ফলটিকে ভিন্ন নামে চেনেন। চাকমারা বলেন হনাগুলো (হনা)। ত্রিপুরা গোষ্ঠীর কাছে পরিচিত টকারুঙ নামে। আর মারমারা ডাকেন ক্রংশ্যাসি। অন্য সম্প্রদায়গুলোও নিজেদের মতো করে নাম রেখেছে কানাইডিঙ্গার।

পাহাড়ের বনাঞ্চলে থাকা বাসিন্দারা জানান, কানাইডিঙ্গাগাছ ২০ থেকে ৩০ ফুট উঁচু হতে পারে। জুন মাসের মাঝামাঝি কানাইডিঙ্গা ফল বাজারে আসতে শুরু করে।

রাঙামাটির বনরূপা বাজারসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন বাজারে এখন ফলটি পাওয়া যাচ্ছে। তবে জুলাই মাসের মাঝামাঝি বাজারে প্রচুর পাওয়া যায় এই ফল।

সম্প্রতি বনরূপা বাজারে আকারভেদে প্রতিটি ফল ১৫০ থেকে ৩৫০ টাকা করে বিক্রি করতে দেখা যায়। এর ওজন হয় ২৫০ গ্রাম থেকে ৪০০ গ্রাম পর্যন্ত। কেজি হিসাবে কানাইডিঙ্গা ফলের দাম পড়ে ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা।

কানাইডিঙ্গাগাছ বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলেই বেশি দেখা যায়। এ ছাড়া ভুটান, ভারত, চীন, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, ফিলিপাইনসহ বেশ কিছু দেশে গাছটি পাওয়া যায়। এর বৈজ্ঞানিক নাম Oroxylum indicum

কানাইডিঙ্গা ফল ও ফুল শত বছর ধরে সবজি হিসেবে খেয়ে আসছেন পাহাড়িরা। আজ থেকে ২০ বছর আগে বনজঙ্গলে গিয়ে ছিঁড়ে নিয়ে এলেই হতো। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামে সামাজিক বনায়ন, ফলদ বাগান গড়ে ওঠায় এবং বন কেটে ফেলায় প্রাকৃতিকভাবে গজিয়ে ওঠা অন্যান্য গাছের মতো কানাইডিঙ্গাও হারিয়ে যাচ্ছে। সে জন্য হাটবাজারগুলোতে চড়া দামেই বিক্রি হচ্ছে ফলটি। শুধু পাহাড়ের হাটবাজারই নয়, ঢাকা–চট্টগ্রামসহ পাহাড়ি সম্প্রদায়–অধ্যুষিত এলাকায় ফলটি বিক্রি হতে দেখা যায়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কানাইডিঙ্গাগাছের মূল ও ছাল, ফল ও পাতা জন্ডিস, শরীরব্যথার মতো সমস্যায় ওষুধ হিসেবে কাজে লাগে। জন্ডিস হলে ছাল বেটে গুড়ের সঙ্গে মিশিয়ে শরবত করে খেলে উপকার পাওয়া যায়। এ ছাড়া অজীর্ণ, ডায়রিয়া, আমাশয়, কোষ্ঠকাঠিন্য, বাতজ্বরসহ নানা রোগের ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করেন অনেকে। কানাইডিঙ্গা ভারতে আয়ুর্বেদিক ওষুধের উপাদান হিসেবেও ব্যবহার করা হয় বলে জানা গেছে।

কানাইডিঙ্গা ফুল
ছবি: মোকারম হোসেন

ছোটবেলা থেকে কানাইডিঙ্গার ফল সবজি হিসেবে খেয়ে আসছেন শিক্ষাবিদ ও গবেষক মংসানু চৌধুরী। তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘কানাইডিঙ্গা সবজি আমাদের একধরনের ঐতিহ্যের অংশ। যদিও কানাইডিঙ্গার বিষয়ে প্রতিষ্ঠিত কোনো গবেষণা তথ্য নেই। আমরা বিশ্বাস করি, এটি বহু ভেষজ গুণে ভরা।’ তিনি বলেন, প্রাকৃতিক বন ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় কানাইডিঙ্গা এখন তেমন পাওয়া যায় না। ভেষজ গুণের এই গাছটি রক্ষা করা প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।

কাপ্তাইয়ে অবস্থিত পাহাড়ি কৃষি গবেষণা কেন্দ্রে পার্বত্য এলাকার নানা ধরনের ফল ও ফসল নিয়ে গবেষণা করে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে বিরল হয়ে পড়া কানাইডিঙ্গা নিয়ে এখন অবধি কোনো কাজ শুরু করেনি। এখানকার বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা শ্যাম প্রসাদ চাকমার দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বললেন, আগামী বছর থেকে কানাইডিঙ্গা নিয়ে কাজ করার চিন্তাভাবনা রয়েছে। তাঁর আশা, সঠিকভাবে কাজ করতে পারলে কানাইডিঙ্গাগাছটি রক্ষা করা যাবে।