শীত পড়তে শুরু করেছে। আমাদের দেশের উত্তরাঞ্চলে এর তীব্রতা কিছুটা বেশি। হেমন্তের আকাশ পরিষ্কার থাকলে পঞ্চগড় ও এর আশপাশ থেকে খুব ভালোভাবে হিমালয়ের কিছু অংশ দেখা যায়। শীতে পুরো হিমালয় বরফে ঢেকে যায়। এ সময় ওই অঞ্চলে প্রাণীদের খাদ্যসংকট হয়। বড় সমস্যায় পড়ে এ এলাকার সবচেয়ে বড় পাখি হিমালয় গৃধিনী শকুন। বিশালদেহী শকুনটি লম্বায় প্রায় ৪ ফুট এবং ওজন প্রায় ১২ কেজি। এ–জাতীয় শকুন মূলত মরা পশু ও প্রাণী খেয়ে থাকে। শীতে বরফঢাকা এলাকায় খাবার না পেয়ে এই পাখিগুলো পরিযায়ন করে আমাদের দেশে চলে আসে। প্রতি শীতে প্রায় ১০০টি পাখি আমাদের দেশের সীমানায় দেখা যায়।
শীতে এ দেশে আসা প্রায় অর্ধেক শকুনই মাটিতে পড়ে যায়, উড়তে পারে না। বিশেষ করে বাচ্চা পাখিগুলোর ক্ষেত্রে এ রকম ঘটনা বেশি ঘটে। মূলত দুর্বলতা থেকেই এ রকমটি ঘটে থাকে। হিমালয় থেকে এ দেশের সমতল ভূমিতে আসতে হিমালয় গৃধিনীকে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হয়। কোনো কোনো সময় পথটি দুই হাজার মাইলের বেশি। আমাদের ভূমিতে এসে তারা সহজেই মরা প্রাণী খুঁজে পায় না। এতে পাখিগুলোকে বেশ কিছুদিন খাবার না খেয়ে থাকতে হয়।
২০১৪ সাল থেকে হিমালয় গৃধিনী নিয়ে সরকারের বন অধিদপ্তর আর বেসরকারি সংস্থা আইইউসিএন কাজ করছে। এ কাজের সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত আছি। মূলত মাটিতে পড়ে যাওয়া অথবা লোকালয়ে আটকে পড়া শকুনগুলো উদ্ধার করে পরিচর্যা করা হয়। দিনাজপুরের সিংড়ায় একটি শকুন উদ্ধার ও পরিচর্যাকেন্দ্র তৈরি করা হয়েছে। গত বছর পর্যন্ত প্রায় ১১৪টি শকুন উদ্ধার করা হয়েছে। পরিচর্যাকেন্দ্রে সুস্থ করে তাদের আবার প্রকৃতিতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, যা এ উপমহাদেশে শকুন রক্ষায় একটি বিরল উদাহরণ।
সাধারণ মানুষের কাছে শকুন উদ্ধার করতে গেলে তারা হরেক রকমের গল্প ফাঁদে। কেউ শকুনের বিনিময়ে লাখ টাকা দাবি করে। একবার একটি শকুন নিয়ে ফেরার পথে ভয়ংকর ছিনতাইকারীর খপ্পরে পড়েছিলাম। গত বছর শকুন নিয়ে এক মুদিদোকানি তাঁর দোকান বন্ধ করে বেশ কয়েক দিন পালিয়ে ছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন মহামূল্যবান সম্পদ পেয়েছেন। এমনকি রংপুরে কিছু মানুষ একটি শকুনকে পরিযায়ী পাখি ভেবে রান্না করে খেয়ে ফেলেছিলেন। সাধারণত মানুষের কাছে পাখিটি প্রায় অজানা বলেই এসব অদ্ভুত ঘটনা ঘটে। এত কিছুর পরও আমরা থেমে নেই। সাধারণ মানুষকে বুঝিয়ে অসুস্থ শকুনকে আনা হয় উদ্ধার কেন্দ্রে।
শীত শেষে পরিযায়ী হিমালয় গৃধিনীরা এ দেশ থেকে বিদায় নেয়। মূলত এরা তিন মাস এ দেশে বসবাস করে। আটকে পড়া শকুনগুলোর ওজন থাকে তিন থেকে পাঁচ কেজি। আমরা প্রতি সপ্তাহে প্রতিটি শকুনকে তিন কেজি মাংস সরবরাহ করি। এতে পাখিগুলো ওজনে ৭ থেকে ৯ কেজি হয়ে সুস্থ হয়ে ওঠে।
আমাদের দেশের ছয় প্রজাতির শকুনের মধ্যে হিমালয় গৃধিনীই সবচেয়ে বড় শকুন। প্রকৃতির ঝাড়ুদারখ্যাত এ পাখি মানুষের কোনো ক্ষতি করে না। মরা প্রাণী খেয়ে রোগের জীবাণু বিস্তার রোধে দারুন সফল। তাই শকুন মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি রোধে বেশ ভূমিকা রাখে।
হিমালয় গৃধিনী নিয়ে উত্তরাঞ্চলে গত পাঁচ বছরে সচেতনতা বেড়েছে। বেশ কটি ছোট ছোট সংগঠনসহ সাধারণ মানুষ এই পাখি উদ্ধারে বড় ভূমিকা রাখছে। শকুন পেলেই আমাদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে। এ বছরের প্রথম শকুনটি ঠাকুরগাঁও থেকে উদ্ধার হয়েছে ২০ নভেম্বর। যেকোনো জায়গায় আটকে পড়া শকুনের খবর জানলে স্থানীয় বন অধিদপ্তরকে খবর দিন। শকুন সংরক্ষণ দল পৌঁছে যাবে উদ্ধারে। প্রতিবছর এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে আমরা উদ্ধার করা শকুনগুলো আবার প্রকৃতিতে ছেড়ে দিই। উড়ে যাওয়া পাখির পায়ে থাকে বিশেষ ধরনের রিং আর ডানায় থাকে বাংলার পতাকার আদলে তৈরি লাল–সবুজ ট্যাগ। এই বিশালদেহী পাখি যখন ডানা মেলে আকাশে উড়াল দেয়, তখন আমাদের আনন্দের সীমা থাকে না।