আমাদের পরিযায়ী পাখি

>

আমাদের পরিবেশ ও প্রতিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য পাখি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিবছর আমাদের দেশে প্রচুর পরিযায়ী পাখি আসে এবং শীত শেষে ফিরে যায়। শীত চলে গেলেও দেশের বিভিন্ন হাওর-বাঁওর-জলাশয়ে এখনো কিছু পরিযায়ী পাখি দেখা যাচ্ছে। এই পাখিগুলোর মধ্যে অনেকগুলো এখন বিপন্ন শ্রেণির পাখি। সম্প্রতি টাঙ্গুয়ার হাওরে এ রকম কিছু পাখির ছবি তোলা হয়েছে।

লালঝুঁটি ভূতিহাঁস। ছবি: লেখক
লালঝুঁটি ভূতিহাঁস। ছবি: লেখক


১. লালঝুঁটি ভূতিহাঁস (Red-crested pochard):
লালঝুঁটি ভূতিহাঁস একধরনের বিরল হাঁস। এরা বাংলাদেশের পরিযায়ী পাখি। শীতকালে এদের ঢাকা, রাজশাহী, সিলেট, পঞ্চগড় ও খুলনা অঞ্চলে দেখতে পাওয়া যায়। লালঝুঁটি ভূতিহাঁস আকারে বড় হয়। এদের ঠোঁট লাল। বুকের রং কালো। পাঁজর সাদা। দেহের পেছনের অংশ বাদামি। লেজ কালো রঙের হয়। স্ত্রী হাঁসটি দেখতে ফ্যাকাশে বাদামি রঙের ও মুখ সাদাটে রঙের। মাথার ওপরের অংশ এবং দেহের পেছনের অংশ গাঢ় রঙের হয়ে থাকে।

লালঝুঁটি ভূতিহাঁস সাধারণত শাকাহারী স্বভাবের। এদের খাদ্যতালিকায় রয়েছে বীজ মূল এবং বিভিন্ন ধরনের জলজ উদ্ভিদ। তবে মাঝেমধ্যে এরা শামুক, উভচর প্রাণী ও ছোট মাছ খেয়ে থাকে। এরা দলবদ্ধ হয়ে থাকতে পছন্দ করে। এদের মিঠাপানির নদীতে ও লোনাপানিতে দেখতে পাওয়া যায়।

লালঝুঁটি ভূতিহাঁসের প্রজনন মৌসুম হলো মধ্য এপ্রিল থেকে জুনের প্রথম সপ্তাহ। এরা পানির কাছাকাছি বাসা তৈরি করে। স্ত্রী হাঁসটি ৬ থেকে ১২টি ডিম পাড়ে। ডিমগুলো দেখতে সবুজাভ। স্ত্রী হাঁস একাই ডিমে তা দেয়। ডিম ফুটে বাচ্চা বের হতে সময় লাগে ২৬ থেকে ২৮ দিন।

বেগুনি কালেম। ছবি: লেখক
বেগুনি কালেম। ছবি: লেখক


২. বেগুনি কালেম (Purple Swamphen):
বেগুনি কালেম পাখি সাধারণত বিল ও হাওর এলাকায় বাস করে। বাংলাদেশের হাতে গোনা কয়েকটি জায়গায় কালেম দেখা যায়। সবচেয়ে বেশি দেখা যায় মৌলভীবাজারের বাইক্কা বিলে ও টাঙ্গুয়ার হাওরে। বছরের ৯ মাস এই বিলে থাকে তারা। বাকি তিন মাসের জন্য এরা পাহাড়ে চলে যায়। সেই তিন মাস হলো জুলাই, আগস্ট ও সেপ্টেম্বর। কচুরিপানা এদের খুব পছন্দ। কচুরিপানার জঞ্জালে ঘুরে ঘুরে খাবার খোঁজে বেগুনি কালেম। চলাফেরা করে দল বেঁধে। এরা ঘাস আর জলজ উদ্ভিদ খেয়ে বেঁচে থাকে। এদের শত্রু বেশি বলে শত্রুর হাত থেকে বাঁচার জন্য দল বেঁধে থাকতে পছন্দ করে এরা। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এরা শুধু নিজেদের মধ্যেই নয়, অন্য জলচর পাখিদের সঙ্গেও দল বাঁধে। কালেম শুধু ঘাস-পাতা নয়, ছোট ছোট মাছ, কেঁচো, পানির পোকা, জোঁক, মাকড়সা, ফড়িংও খায়। খাবার খোঁজার সময় লেজ নাড়ায়। তখন লেজের নিচের সাদা পালক দেখা যায়। এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর মাসে জলার ধারে ঝোপঝাড়ের ভেতর এরা বাসা বাঁধে। বেগুনি কালেম তিন থেকে পাঁচটি ডিম পাড়ে। ডিমের রং হয় ফ্যাকাশে সাদা। ডিমের গায়ে কালো তিলের দাগ থাকে। কালেমের ডিম আকৃতিতে মুরগির ডিমের সমান হয়।

উত্তরে ল্যাঞ্জাহাঁস। ছবি: লেখক
উত্তরে ল্যাঞ্জাহাঁস। ছবি: লেখক


৩. উত্তরে ল্যাঞ্জাহাঁস (Northern Pintail)
উত্তরে ল্যাঞ্জাহাঁস সাধারণত বড় আকারের হয়। এদের পাখার দৈর্ঘ্য ৯ দশমিক ৩ থেকে ১১ দশমিক ১ ইঞ্চি পর্যন্ত হয়ে থাকে এবং ওড়ার সময় পাখার বিস্তৃতি হয় ৩১ থেকে ৩৭ ইঞ্চি পর্যন্ত। পুরুষ হাঁসটি আকারে ২৩ থেকে ৩০ ইঞ্চি দীর্ঘ হতে পারে। এর ওজন সাধারণত ৪৫০ থেকে ১৩৬০ গ্রাম মতো হয়ে থাকে। এদের মাথার রং চকলেট খয়েরি। বুকের রং সাদা, যা গলার পাশ পর্যন্ত বিস্তৃত হয়।

উত্তরে ল্যাঞ্জাহাঁসের ওপরের অংশ ও পাশের অংশ ধূসর রঙের হয়। এদের দেহের পেছন থেকে কাঁধ পর্যন্ত কালো দাগ থাকে, যা ধূসর পালক দিয়ে ঢাকা। এর ঠোঁট নীলাভ ও পায়ের রং ধূসর নীল। পূর্ণবয়স্ক স্ত্রী উত্তরে ল্যাঞ্জাহাঁসের চেয়ে আকারে পুরুষ হাঁস থেকে ছোট হয়। এরা হালকা খয়েরি রঙের হয় এবং মাথার রং ধূসর খয়েরি। এদের লেজ পুরুষ পাখিটি থেকে ছোট হয়। অপ্রাপ্তবয়স্কদের দেখতে স্ত্রীর মতো লাগে তবে এদের পাখার রং হয় ধূসর খয়েরি ও লেজ ছোট হয়ে থাকে।

সিঁথিহাঁস। ছবি: লেখক
সিঁথিহাঁস। ছবি: লেখক


৪. সিঁথিহাঁস (Eurasian wigeon):
ইউরেশীয় সিঁথিহাঁস দলবদ্ধভাবে বসবাস করে। বড় জলাশয়ে এদের সহজে দেখা মেলে। উদ্ভিদের বীজ ও ছোট ছোট জলজ জীব এদের প্রধান খাদ্য।
পাখিটি বাংলাদেশ, ভারত ছাড়াও ইউরোপ, আফ্রিকা, উত্তর আমেরিকা ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশে দেখা যায়। সারা পৃথিবীতে এক বিশাল এলাকাজুড়ে এরা বিস্তৃত, প্রায় ১ কোটি ২৯ লাখ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে এদের আবাস। কয়েক দশক ধরে এদের সংখ্যা ক্রমেই কমছে, তবে এখনো আশঙ্কাজনক পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেনি।

মরচে–রং ভূতিহাঁস। ছবি: লেখক
মরচে–রং ভূতিহাঁস। ছবি: লেখক


৫. মরচে–রং ভূতিহাঁস (Ferruginous pochard l white-eyed pochard):
মরচে–রং ভূতিহাঁস বা ভূতিবিশিষ্ট হাঁস (ইংরেজি Ferruginous Duck or Ferruginous Pochard) (Aythya nyroca) অ্যানাটিডি পরিবারের অ্যাইথিয়া গণের এক প্রজাতির মধ্যম আকারের ডুবুরি হাঁস। এই প্রজাতি অত্যন্ত সুলভ। এরা বাংলাদেশের পরিযায়ী পাখি। এই প্রজাতিকে ঢাকা, সিলেট, রাজশাহী ও বরিশাল অঞ্চলে দেখতে পাওয়া যায়। আইইউসিএন এই প্রজাতিটিকে প্রায়-বিপদগ্রস্ত (Near Threatened) বলে ঘোষণা করেছে।

স্ত্রী হাঁসের ওজন প্রায় ৫২০ গ্রাম। পুরুষ হাঁসটির গায়ের রং পিঙ্গল বর্ণের। দেহের পেছনের অংশ গাঢ় এবং চোখ হলুদ। লেজের নিচের অংশ সাদা। স্ত্রী হাঁসটি দেখতে অনেকটা পুরুষ হাঁসের মতো। কিন্তু এদের গায়ের রং কিছুটা মলিন এবং চোখ গাঢ় রঙের।

মরচে–রং ভূতিহাঁস নিশাচর পাখি। এরা রাতের বেলা খাবার খুঁজতে বের হয়। এরা পানিতে ডুব দিয়ে খাবার সংগ্রহ করে। এদের খাদ্যতালিকায় আছে জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণী; যেমন, সবুজ শৈবাল, শামুক, জলজ পোকামাকড়, ছোট মাছ ইত্যাদি।

এই প্রজাতির প্রজনন মৌসুম হলো মধ্য মে থেকে জুলাই। এরা বাসা বানায় পানির কাছাকাছি, যেখানে সহজে খাবার পাওয়া যায়। স্ত্রী পাখিটি ৭ থাকে ১১টি ডিম পাড়ে। ডিমগুলো দেখতে হলদে ধূসর বর্ণের। স্ত্রী হাঁস একাই ডিমগুলোয় তা দিয়ে থাকে। ডিম ফুটে বাচ্চা বের হতে সময় লাগে ২৫ থেকে ২৭ দিন। বাচ্চা গুলো ৫৫ থেকে ৬০ দিনের মধ্যে উড়তে পারে। স্ত্রী হাঁসটির ওজন প্রায় ৫২০ গ্রাম। পুরুষ হাঁসটির গায়ের রং পিঙ্গল বর্ণের। দেহের পেছনের অংশ গাঢ় এবং চোখ হলুদ। লেজের নিচের অংশ সাদা। স্ত্রী হাঁসটি দেখতে অনেকটা পুরুষ হাঁসের মতো। কিন্তু এদের গায়ের রং কিছুটা মলিন এবং চোখ গাঢ় রঙের।

পিয়াং-হাঁস। ছবি: লেখক
পিয়াং-হাঁস। ছবি: লেখক


৬. পিয়াং-হাঁস (Gadwall l):
পিয়াং–হাঁস দলবদ্ধভাবে বসবাস করে। বড় জলাশয়ে এদের সহজে দেখা যায়। উদ্ভিদ বীজ ও ছোট ছোট জলজ জীব এদের প্রধান খাদ্য। এর একটি উপপ্রজাতি ওয়াশিংটন দ্বীপের পিয়াং–হাঁস ১৮৭৪ সালে পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। পাখিটি বাংলাদেশ, ভারত ছাড়াও ইউরোপ, আফ্রিকা, উত্তর আমেরিকা ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশে দেখা যায়।

লেখক: বগুড়া বার্ড ক্লাবের সদস্য ও আলোকচিত্রী