আম্পানের চেয়েও বেশি জোয়ারে ভাসছে উপকূল

অস্বাভাবিক জোয়ারের পানিতে ভেঙে গেছে গ্রামের প্রধান সড়কের বিভিন্ন অংশ। তীব্র স্রোতের কারণে এ পথে চলার সময় অন্যের সাহায্য নিতে হচ্ছে অনেককে। গতকাল সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগর গ্রামে।
ছবি: প্রথম আলো

ঘূর্ণিঝড় আম্পানের চেয়েও উঁচু জোয়ারে দেশের উপকূলের বেশির ভাগ জেলা প্লাবিত হয়েছে। এতে বরিশাল ও খুলনা বিভাগের অনেক এলাকায় বাঁধ ভেঙে পানি ঢুকেছে। বাড়িতে জোয়ারের পানি ওঠায় কয়েক লাখ মানুষ উঁচু স্থানে আশ্রয় নিয়েছে। পূর্বপ্রস্তুতি না থাকায় হঠাৎ এই বন্যায় ভোগান্তিতে পড়েছে মানুষ।

দুই দিন ধরে চলা এই প্লাবনকে স্বল্পস্থায়ী বন্যা বলছে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র। তারা বলছে, আজ রোববারের মধ্যে এই পানি নামতে শুরু করবে। কাল সোমবারের মধ্যে পানি পুরোপুরি নেমে যাবে। এই সময়ের মধ্যে বৃষ্টিও কমে আসতে পারে। ৫৬ দিন ধরে উজান থেকে আসা ঢলের পানিও এই সময়ের মধ্যে পুরোপুরি নেমে যেতে পারে।

এ ব্যাপারে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুজ্জামান ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, গত বৃহস্পতিবার থেকে বঙ্গোপসাগরে আবহাওয়ার তিনটি বৈরী রূপ একসঙ্গে তৈরি হয়েছে। প্রথমত, মৌসুমি বায়ু হঠাৎ করে শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। ফলে একই সঙ্গে দমকা বাতাস ও প্রচুর মেঘ তৈরি হয়ে বৃষ্টি ঝরাচ্ছে।

দ্বিতীয়ত, বঙ্গোপসাগরে ১০ দিনে পরপর দুটি সুস্পষ্ট লঘুচাপ তৈরি হয়েছে। বৃহস্পতিবার থেকে তৈরি হওয়া লঘুচাপটি ছিল বেশ শক্তিশালী। এর প্রভাবে সাগর উত্তাল হয়ে ওঠে। তৃতীয়ত, ১৮ আগস্ট ছিল অমাবস্যা, ফলে সাগরের পানির উচ্চতা এমনিতেই বেড়ে গিয়েছিল। এই তিনটি কারণ একসঙ্গে মিলে জোয়ারের উচ্চতা ও গতি একই সঙ্গে বেড়ে যায়।

বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র বলছে, দুই দিন ধরে শুরু হওয়া উপকূলীয় বন্যায় মোট ১০টি জেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এর মধ্যে বরিশালে কীর্তনখোলা, তেঁতুলিয়া, নয়াভাঙানী নদীর পানি; ঝালকাঠিতে বিশখালী ও ভোলায় সুরমা-মেঘনার জোয়ারের পানি ঘূর্ণিঝড় আম্পানের সময়ের চেয়েও উঁচুতে ওঠে। গত ২১ মে বাংলাদেশ ও ভারতে আঘাত হানা ওই ঝড়ে দেশের উপকূল থেকে উত্তরাঞ্চল পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকায় ব্যাপক ক্ষতি হয়।

আমাদের প্রতিনিধি, বরিশাল জানান, অতিবৃষ্টির কারণে বরিশাল শহরের বেশির ভাগ এলাকায় জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে।

অধিক উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলার ১৫টি ইউনিয়নের অন্তত ৫০ হাজার পরিবার চরম দুর্ভোগে আছে। এসব এলাকার রাস্তাঘাট ও সেতু জোয়ারের তোড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ঘরবাড়িতে পানি উঠে যাওয়ায় এসব এলাকার লোকজন রাতে বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নেয়। চানপুর, চরগোপাল, জয়নগর, ধূলিচর-খাজুরিয়া, শ্রীপুর, গোবিন্দপুর ইউনিয়নের অবস্থা সবচেয়ে খারাপ।

প্রতিনিধি, সাতক্ষীরা জানান, প্রবল বৃষ্টি ও জোয়ারের পানিতে আশাশুনি ও শ্যামনগরের ৬০ গ্রামের লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। ঘূর্ণিঝড় আম্পানের সময়ও এসব গ্রামের অধিবাসীরা জলোচ্ছ্বাসের কবলে পড়ে। এসব গ্রামের রাস্তাঘাট, চিংড়িঘের ও ফসলি জমি সব পানিতে একাকার হয়ে গেছে।

সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলায় রাতে বিকট শব্দে বেড়িবাঁধ ভেঙে যায়। বসতি এলাকায় পানি ঢুকে পড়ে। আম্পানের পর রিং বাঁধ দেওয়ায় কয়েকটি গ্রামে পানি কিছুটা কমেছিল। নতুন করে খোলপেটুয়া নদীর পানি বেড়ে যাওয়ায় মানুষ ছুটছে নতুন আশ্রয়ের খোঁজে। রাস্তা, ফসলি জমি কিংবা চিংড়িঘের আলাদা করে চিহ্নিত করার উপায় নেই। চারদিকে শুধু পানি আর পানি।

শ্যামনগরের গাবুরা ইউপির চেয়ারম্যান মাসুদুল আলম জানান, কপোতাক্ষ নদের নেবুবুনিয়া রিং বাঁধের ছয়টি স্থানে বৃহস্পতিবার ভেঙে যায়। শুক্রবার দুপুর ১২টার মধ্যে স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে তা মেরামত করা হয়। আবার বেলা দুইটার দিকে সাত স্থানে ভেঙে যায়। এতে চারটি গ্রামের দেড় হাজার পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়ে। ভেসে গেছে চার শতাধিক চিংড়িঘের।

প্রতিনিধি, বাগেরহাট জানান, শহরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ভৈরব, মোংলার পশুর, মোরেলগঞ্জের পানগুছি, শরণখোলার বলেশ্বর ও মোল্লাহাটের মধুমতী নদীতে স্বাভাবিকের চেয়ে জোয়ারের উচ্চতা অন্তত পাঁচ ফুট বেড়েছে। এতে ওই সব এলাকার বেশির ভাগ স্থান প্লাবিত হয়েছে।

বহরবুনিয়া ইউনিয়ন পরিষদের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য মো. ফরিদ ফকির বলেন, টানা বৃষ্টির সঙ্গে কেওড়া ও পানগুছি নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় বহরবুনিয়া ইউনিয়নের সাড়ে ছয় শতাধিক ঘের ডুবে গেছে। চাষিদের কয়েক কোটি টাকার ক্ষতি হবে। এই ওয়ার্ডের অনেকের বাড়িঘরও তলিয়ে গেছে।

প্রতিনিধি, খুলনা জানান, জোয়ারের পানির চাপে খুলনার কয়রা উপজেলার তিনটি ইউনিয়নের অন্তত আটটি স্থানে বেড়িবাঁধ ভেঙে গেছে। এতে ওই এলাকার পাঁচ হাজার পরিবার নতুন করে পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। এলাকার লোকজন স্বেচ্ছাশ্রমে ভেঙে যাওয়া স্থানগুলো সংস্কারের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিছু এলাকার অস্থায়ী বাঁধ মেরামত সম্ভব হলেও অন্তত তিনটি পয়েন্ট দিয়ে লোকালয়ে এখনো পানি প্রবেশ করছে।

গত বুধবার জোয়ারের পানিতে কয়রা উপজেলার কাজীপাড়া, পুঁটিহারী, হরিণখোলা, কাশিরহাট খোলা, ঘাটাখালী প্লাবিত হয়েছিল। এরপর বৃহস্পতিবার জোয়ারের পানির চাপে ঘাটাখালী, ২ নম্বর ও ৩ নম্বর কয়রায় বাঁধ ভেঙে যায়। মানুষ স্বেচ্ছাশ্রমে বাঁধ আটকে ফেলে। পরে শুক্রবার আবারও সেই বাঁধ ভেঙে যায়।

কয়রা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক ইমতিয়াজ উদ্দিন বলেন, বুধবার জোয়ারের অতিরিক্ত পানির তোড়ে বাঁধ উপচে বিভিন্ন গ্রামে পানি ঢোকে। বৃহস্পতিবার নতুন করে আবারও কয়েকটি পয়েন্ট ভেঙে যায়। স্বেচ্ছাশ্রমে মেরামত করা পয়েন্টগুলোর কয়েকটি শুক্রবারের জোয়ারের চাপে ভেঙে যায়। গতকাল শনিবারও জোয়ারের উচ্চতা বেশি ছিল। মানুষ স্বেচ্ছাশ্রমে কাজ করে যাচ্ছে, তবে এখনো পানি ঢোকা রোধ করা যায়নি।