আরাঙ্গার পরিযায়নের অসাধারণ গল্প

পরিযায়ী এই ইগলের গায়ে গত বছরের ২০ আগস্ট মঙ্গোলিয়ার বুনটসাগান লেকে স্যাটেলাইট যন্ত্র বসিয়ে দেওয়া হয়। ওই বছরের ১৯ সেপ্টেম্বর টাঙ্গুয়ার হাওর থেকে তোলা
ছবি: সাকিব আহমেদ

আরাঙ্গা নামের একটি পরিযায়ী পালাসি কুড়া ইগল গত বছরের ১৯ সেপ্টেম্বর টাঙ্গুয়ার হাওরে পৌঁছায়। পাখিটির গায়ে একটি স্যাটেলাইট যন্ত্র বসিয়ে তার পরিযায়ন রহস্য বের করার চেষ্টা করছিলাম আমরা। ফলে পাখিটির প্রতিদিনের খবরই আমরা জানি। গত বছরের আগস্ট মাসের ২০ তারিখ দক্ষিণ মঙ্গোলিয়ার গোবি মরুভূমির বুনটসাগান লেকে পাখিটির গায়ে যন্ত্রটি বসান আমার গবেষক বন্ধু ব্যাটমুনখ দাভারাসেন।

এই মেয়ে কুড়া ইগল যন্ত্রটি বসানোর সাত দিনের মাথায় মঙ্গোলিয়া থেকে চীনের সীমানায় প্রবেশ করে। এরপর পাখিটি ৩১ দিনে ৩ হাজার ৭৩২ কিলোমিটার ভ্রমণ করে ১৯ সেপ্টেম্বর টাঙ্গুয়ার হাওরে এসে পৌঁছায়। ভারতীয় সীমানার মেঘালয় পাহাড়ের পাদদেশ থেকে পাখিটি টাঙ্গুয়ার হাওরে যাতায়াত করে সাত দিন। আমরা মনে করেছিলাম মেঘালয় সীমানায় পাখিটির বাসা আছে। খাবারের সন্ধানে শুধু টাঙ্গুয়ার হাওরে আসে। কিন্তু ১ অক্টোম্বর থেকে আরাঙ্গা পাখিটি বাংলাদেশের সুনামগঞ্জ জেলার তাহিরপুর উপজেলার শ্রীপুর গ্রামে বসবাস শুরু করে। একটা সঙ্গীর সঙ্গে জোড়ও বাঁধে। একটি শিমুলগাছে ১৫ অক্টোম্বর থেকে বাসা বানানো শুরু করে। শিমুলগাছটির মালিক শাহ আলম। তাঁদের চার ভাইকে আমরা বোঝাতে সক্ষম হই যে এটি একটি বিরল পাখি। নতুন বাসায় কোনো রকম অত্যাচার করা যাবে না।

আরাঙ্গা ও তার সঙ্গী ২৩ দিনের প্রচেষ্টায় বাসা বানানো সম্পূর্ণ করে। এ সময় তারা তিন মাইলের মধ্যে ঘোরাফেরা করে খাবার সংগ্রহ করে। এরপর আরাঙ্গা বাসায় নিয়মিত বসে থাকে। মনে হয়েছিল তারা ডিমে তা দিচ্ছে। আমাদের ইচ্ছা ছিল আরাঙ্গার বাচ্চা ফুটলে তাদের পিঠেও স্যাটেলাইট যন্ত্র বসিয়ে দেব। কিন্তু ৭ জানুয়ারি ২০২১ আমরা বুঝতে পারি আরাঙ্গা আর ডিমে তা দিচ্ছে না। তারা বাসা ছেড়ে বিভিন্ন জায়গায় বিচরণ করছে। পাখি দুটি এ বছরই প্রথম জোড় বাঁধে ও সংসার শুরু করে। আগামী বছর হয়তো ডিম পেড়ে বাচ্চা ফোটাবে।

আরাঙ্গা টাঙ্গুয়ার হাওর থেকে এ বছরের ১ মার্চ প্রথম বাংলাদেশের সীমানা পার হয়ে একবার ভারতে গেছে এবং সেদিনই ফিরে আসে। গত ৪ এপ্রিল আরাঙ্গা তার চূড়ান্ত পরিযায়ন শুরু করে এবং ৬ এপ্রিল হিমালয় পর্বত পাড়ি জমায়। এরপর ৮ দিনে সে উত্তর চীনের হেইহে নদীর পাদদেশে পৌঁছায়। ৬ মে পর্যন্ত আরাঙ্গা ওই নদীর তীরবর্তী এলাকায় বিচরণ করছে। হয়তো সেখানে আরও কিছুদিন কাটিয়ে আবার বুনটসাগান লেকে ফিরে যাবে।

৪ এপ্রিল টাঙ্গুয়ার হাওর থেকে ওড়া শুরু করে ১৪ এপ্রিল উত্তর চীনের হেইহে নদীর তীরে পৌঁছায় আরাঙ্গা।

গবেষণায় দেখা গেছে, আরাঙ্গা বছরের ২০১ দিন কাটিয়েছে বাংলাদেশে আর ১২৫ দিন কাটিয়েছে মঙ্গোলিয়া, চীন আর তিব্বতের বিভিন্ন লেকে। বাকি ৩৯ দিন বিভিন্ন দেশের ওপর দিয়ে সে পরিযায়ন করেছে। এক বছরে সে প্রায় ৯ হাজার মাইল ভ্রমণ করেছে। পাখিটির বেঁচে থাকার জন্য তিব্বত আর মঙ্গোলিয়ার লেক খুবই জরুরি। আর প্রজননকাল কাটানোর জন্য প্রয়োজন টাঙ্গুয়ার হাওর।

সুইডেনের লিনিয়াস বিশ্ববিদ্যালয়ের সহায়তায় আইইউসিএন বাংলাদেশ ও ওয়াইল্ড লাইফ সায়েন্স অ্যান্ড কনজারভেশন সেন্টার অব মঙ্গোলিয়ার কয়েকজন গবেষক এই পাখির পরিযায়ন রহস্য নিয়ে কাজ করছেন। আরাঙ্গার পাশাপাশি আরও ১৪টি কুড়া ইগলের বাসা গবেষকেরা এ বছর নজরদারিতে রাখেন। এর মধ্যে মাত্র চারটি বাসায় ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয়। বেশির ভাগ ইগলই সফলতার সঙ্গে প্রজনকাল সম্পন্ন করতে পারছে না। হাওরে খাবার আর বাসা বানানোর গাছের সংখ্যা কমে গেলে আমাদের সবার প্রিয় এই পাখির পরিযায়নও থেমে যাবে।