আশ্রয়কেন্দ্রের উত্তম বিকল্প ঘূর্ণিঝড়–সহনীয় বাড়ি

সামনে কিছু ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। এমন পরিস্থিতিতে আশ্রয়কেন্দ্র বড় ভরসা। আরও কোনো বিকল্প কি আছে?

পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় ঘূর্ণিঝড়–সহনীয় বাড়ি
ছবি: লেখক

গত বছর এই কার্তিক মাসেই (শনিবার, ৯ নভেম্বর ২০১৯) ঘূর্ণিঝড় বুলবুল আঘাত হানার আগে সংবাদপত্রের খবর ছিল, বারবার মাইকিং করার পরও লোকজনকে আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়া যাচ্ছে না। তারা তাদের ঘরবাড়ি ছেড়ে যেতে অনীহা দেখাচ্ছে। মহাবিপদ সংকেতের কথা বলে জোর করে তাদের আশ্রয়কেন্দ্রে নিতে হচ্ছে।

কোভিডে কাতর বাংলাদেশে আম্পান আঘাত হানে জ্যৈষ্ঠ মাসে (২০ মে ২০২০)। তার আগে ১৯ মে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী জানান, সকাল থেকে আশ্রয়কেন্দ্রে মানুষ নেওয়ার কাজ শুরু হয়েছে। পরদিন সকালে সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার পদ্মপুকুর এলাকার বাসিন্দা জি এম শফিকুল আজম ফোনে জানান, চার কক্ষের দোতলা আশ্রয়কেন্দ্রে তখনো তেমন মানুষ আসেনি। উল্লেখ্য, যেসব জেলায় ঘূর্ণিঝড় আম্পান আঘাত হেনেছিল, এর মধ্যে অন্যতম ছিল সাতক্ষীরা জেলা। নারী ও বয়স্কদের আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়ার জন্য নিয়োজিত স্বেচ্ছাসেবীদের একজন সাবিনা পারভীনের কাছে আশ্রয়কেন্দ্রের পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি সেদিন বলেছিলেন, আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে নানা সংকট। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা সম্ভব হচ্ছে না। আশ্রিতদের কাউকে কোনো মাস্ক দেওয়া হয়নি।

দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের মোট জনসংখ্যা প্রায় তিন কোটি। এর মধ্যে উপকূলীয় ১২ জেলার ১ কোটি ১০ লাখ মানুষ ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের বেশি ঝুঁকিতে আছে। তাদের জন্য সরকারিভাবে ৩ হাজার ৭৭০টি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র তৈরি করা হয়েছে। ঘূর্ণিঝড় হানা দিলে বিভিন্ন সরকারি–বেসরকারি স্থাপনা মিলিয়ে মোট আরও প্রায় ১২ হাজার ভবন আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা যায়। এসব জায়গায় প্রায় ৫১ লাখ মানুষ আশ্রয় নিতে পারে। তবে এর সব কটিই যে ব্যবহার উপযোগী অবস্থায় আছে, তা হলফ করে বলা যাবে না।

চার বছর আগে প্রায় পৌনে তিন কোটি টাকা ব্যয়ে ঝালকাঠি সদর উপজেলার পোনাবালিয়া ইউনিয়নের পশ্চিম দেউরী গ্রামে বিষখালী নদীর তীরে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় কাম সাইক্লোন শেল্টার নির্মাণ করা হয়েছিল। ইমার্জেন্সি সাইক্লোন রিকভারি অ্যান্ড রেস্টোরেশন প্রজেক্টের আওতায় বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে এলজিইডির বানানো ইমারতটির একাংশ চলে গেছে বিষখালী নদীতে। আতঙ্কে বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী আসা প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। শিক্ষকেরা স্কুলে এলেও ভয়ের মধ্যে থাকেন। ঘূর্ণিঝড় ফণীর আঘাত থেকে বাঁচার জন্য প্রশাসনের চাপে তিন শতাধিক মানুষ আশ্রয় নিয়েছিল এই বিদ্যালয় কাম সাইক্লোন শেল্টারে। ঝুঁকির কারণে রাতে অনেকেই সেখান থেকে নেমে যায়।

আশ্রয়কেন্দ্র কতটা ভূমিকা রাখছে

এত কিছুর পরও ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র বা সাইক্লোন শেল্টার জলোচ্ছ্বাসপ্রবণ দক্ষিণাঞ্চলের জন্য প্রাণ রক্ষার একমাত্র সহজ সমাধান হিসেবে উন্নয়ন সহযোগীদের কাছে বেশ জনপ্রিয়। সড়ক দুর্ঘটনার তথাকথিত ‘জনপ্রিয়’ সমাধান স্পিডব্রেকার যেমন দুর্ঘটনা রোধ করে না, তেমনি জলোচ্ছ্বাসের হুমকি থেকে জননিরাপত্তার বাতাবরণ তৈরিতে আশ্রয়কেন্দ্র কতটা কার্যকর ভূমিকা রাখছে, তা ভেবে দেখার সময় এসেছে।

আশ্রয়কেন্দ্র তৈরির শুরু থেকেই গবেষকেরা গবেষণা করে চলেছেন, মানুষ কেন সময়মতো সেখানে যায় না? কেন নারীরা দেরি করে যান? গেলেও কেন বাড়ি ফেরার জন্য তাঁরা ছটফট করেন? এসব গবেষণায় ঝুঁকিতে থাকা মানুষদের অর্থবহ মতামত কতটা যথাযথভাবে এসেছে, তা বলা যাবে না। আর পাঁচটা গবেষণার মতো আশ্রয়কেন্দ্র ব্যবহার করা না–করার গবেষণা সহজ ব্যাপার নয়। ফলে সুপারিশই এসেছে বেশি।

সুপারিশগুলো এ রকম:

১. জনসচেতনতা বাড়াতে হবে।

২. পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীদের আরও ক্ষমতায়ন করতে হবে, যাতে তাঁরা পুরুষের কথার অপেক্ষা না করে তলবি খবর পাওয়ামাত্র লোটা–কম্বল নিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে ছুটে যান।

৩. আরও আরও আশ্রয়কেন্দ্র চাই। দোতলা, তিনতলা, চারতলা। পুরুষের জন্য একতলা, নারীর জন্য একতলা ইত্যাদি ইত্যাদি।

৪. আশ্রয়কেন্দ্রকে নারীবান্ধব করতে হবে। চাই আরও টয়লেট, প্রস্রাবখানা বা লেবার রুম। ধরে রাখো বৃষ্টির পানি। বসাও সোলার প্যানেল।

৫. আশ্রয়কেন্দ্রকে প্রতিবন্ধীবান্ধব বানাও। বসিয়ে দাও র‌্যাম্প।

৬. কিশোরী ও নারীদের যৌন হয়রানি রোধ করার জন্য আলাদা কক্ষের ব্যবস্থা করো। ঘিরে দাও পর্দা দিয়ে।

৭. আশ্রয়কেন্দ্রের বাজেটে রাস্তা তৈরির টাকা নেই। তাই আশ্রয়কেন্দ্রে আসার রাস্তা তৈরি হয় না। বর্ষার সময় মানুষ কাদা ভেঙে আসতে পারে না। কাজেই বাজেট বাড়িয়ে তৈরি করো রাস্তা।

৮. আশ্রয়কেন্দ্রের রক্ষণাবেক্ষণ হয় না। ওটাকে বহুমুখী ব্যবহারযোগ্য করে দাও। কমিটি বানাও। আরও কত কী।

৪০ বছর ধরে এ রকম অজস্র সুপারিশ এসেছে। বহু সুপারিশ বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বাস্তবায়নও হয়েছে কিছু কিছু। তবে অবস্থার রকমফের হয়নি। শেষে জোরজবরদস্তি হয়েছে, ‘মারের ওপর ওষুধ নাই’ ধারায় কিছু কম্ম চলেছে। তবু নিজের ইচ্ছায় মানুষ আসে না। এলে মানুষ তার বাড়িতে যতটা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে, ততটা আর কোথাও না। নিজের ঘর, নিজের খাট, নিজের চেয়ার, নিজের বাড়ি কেউ সহজে ছাড়তে চায় না। এটাই আসল কথা।

আশ্রয়কেন্দ্রগুলো কেমন

আপৎকালীন আশ্রয় ব্যবস্থাপনা নিয়ে যতটা না কথা হয়েছে, তার চেয়ে অনেক বেশি হয়েছে আশ্রয়কেন্দ্রের কাঠামো নিয়ে। একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও সামাজিক সংকটের সমাধান খোঁজা হয়েছে প্রকৌশলীদের চোখ দিয়ে। নতুন নতুন কাঠামো তৈরিতে প্রকৌশলীদের আগ্রহ স্বাভাবিকভাবেই বেশি। কিন্তু যেসব মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রগুলো ব্যবহার করবে, তারা কী চায়, কেমন করে চায়, সেটা তো আমাদের আগে ভাবতে হবে।

অবস্থা অনেকটা এমন। আগামী ঝড়ের আগেই ঝড়ের বেগে একটা কিছু করতে হবে। ‘ফান্ডিং’ শেষ করার ‘গর্ভযন্ত্রণায়’ দাতারাও চাপের মধ্যে থাকেন। টাকা নাও। শেষ করো। ছবি তোলো। উদ্বোধন করো। দরকার হলে হলুদ খাম আরও মোটা করো। আমলাদের বশীভূত করো। যিনি বশীভূত হবেন না, তাঁকে বসিয়ে দাও। প্রজেক্ট তবু চলুক। গবেষকেরা গবেষণা করে বলে দেবেন, আমরাই ঠিক।

২০১৪ সালের জুন মাসের মধ্যে ২০০ কোটি টাকা দিয়ে ১০০টি নতুন আশ্রয়কেন্দ্রের কাজ শেষ করার পরিকল্পনা ছিল। অর্থাৎ একেকটি আশ্রয়কেন্দ্র করতে দুই কোটি টাকার বরাদ্দ।

বুয়েটের তৎকালীন অধ্যাপকসহ অন্যদের নিয়ে সরকার গঠিত সাইক্লোন শেল্টার রিভিউ কমিটির হিসাবে, আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে প্রতি একজনের জন্য জায়গা বরাদ্দ দুই বর্গফুট মাত্র। দুই বর্গফুট জায়গায় একজন মানুষ কতক্ষণ থাকতে পারে? প্রতিবন্ধী, চঞ্চল শিশু, গর্ভবতী মা, অপারেশনের রোগী, প্রবীণ মানুষ—সবার জন্যই এই দুই বর্গফুট।

এ টাকায় যা করা সম্ভব

একটা আশ্রয়কেন্দ্র বানানোর ২ কোটি টাকা দিয়ে কমপক্ষে ৩৫ থেকে ৪০টা ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস–সহিষ্ণু বাড়ি তৈরি করা সম্ভব। এসব বাড়িতে কথিত আশ্রয়কেন্দ্রের চেয়ে দ্বিগুণ মানুষকে আশ্রয় দেওয়া সম্ভব। মানুষ অচেনা পরিবেশের আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার চেয়ে প্রতিবেশীর জলোচ্ছ্বাস–সহিষ্ণু বাড়িতে ছুটে গিয়ে ঘণ্টা দুয়েকের আশ্রয় নিতে বেশি স্বাচ্ছ্যন্দ বোধ করবে। মানুষ অনির্ধারিত সময়ের জন্য এতটা দূরে যেতে চায় না, যেখান থেকে তার বাড়ি দেখতে পাওয়া যায় না। এসব বাড়ি সুদমুক্তভাবে সহজ কিস্তিতে দেওয়া যেতে পারে। এ টাকা দেওয়া যেতে পারে পঞ্চম শ্রেণির সমাপনী পরীক্ষার মেধাতালিকার শীর্ষে থাকা, কিন্তু আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়া শিশুটির পরিবারটিকে। অনেক অনেক কৌশল আছে সেসব ঠিক করার।

এমন একটা ভুল ধারণা আছে, নিজের বাড়িতে সংকটের সময় দুষ্ট প্রতিবেশী আশ্রয় না–ও দিতে পারে। তবে আমাদের সামাজিক অবক্ষয়ে অনেক কিছু নষ্ট হলেও সামাজিক পুঁজির এই জায়গাটিতে এখনো পচন ধরেনি। গ্রামাঞ্চলে বাড়ি পুড়ে গেলে মানুষ এখনো ঝাড়ের বাঁশ দান করে। গ্রামে কেউ মারা গেলে কবর খোঁড়ার লোক বিনা পয়সায় পাওয়া যায়। বাঁশ বা খাটিয়া জোগাড় হয় বিনা ক্লেশে। মরা বাড়িতে খাবার যায় সাত বাড়ি থেকে পালা করে।

২ হাজার ২৩৩ বর্গফুট আয়তনের একটি সাধারণ মানের আশ্রয়কেন্দ্র বানাতে খরচ পড়ে ১ কোটি ২০ লাখ টাকা। দাবি অনুযায়ী সেখানে আশ্রয় নিতে পারে আনুমানিক ১ হাজার ৭০০ মানুষ। একেকজনের জন্য ১ দশমিক ৫৫ বর্গফুট। সরকার গঠিত সাইক্লোন শেল্টার রিভিউ কমিটির অনুমোদিত হিসাব দুই বর্গফুটের চেয়েও কম। একই টাকায় ব্যক্তিমালিকানায় বাড়ি দিলে এর চেয়ে বেশি মানুষ বাঁচানো যাবে।

পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় এমন একটি নিরীক্ষা করেছে একটি বেসরকারি উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান। বুয়েটের প্রথিতযশা শিক্ষক, প্রকৌশলী আর স্থপতিদের করা নকশা অনুযায়ী কলামের ওপর দোতলা এসব বাড়ির বারান্দাসহ আয়তন ৩০৪ বর্গফুট। একেকটি বাড়ি বানানোর খরচ ৩ থেকে ৪ লাখ টাকা। ১৯৬ জন মানুষ ঝড়ের সময় এ রকম একেকটা বাড়িতে আশ্রয় নিতে পারবে।

পাটিগণিতের হিসাবে একটা ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রের খরচে এ রকম কমপক্ষে ৩০টি বাড়ি তৈরি সম্ভব। একেকটা বাড়িতে যদি ১৯৬ জনের জায়গায় ১০০ জনও আশ্রয় নেয়, তাহলে ৩০টা বাড়িতে কমপক্ষে ৩ হাজার মানুষের জায়গা হবে। অথচ একেকটি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র টেনেটুনে মাত্র ১ হাজর ৭০০ জন মানুষের স্থান করে দিতে পারে।

ভ্যালু ফর মানির হিসাবে কোনটি বড়? ১ কোটি ২০ লাখ টাকায় ১ হাজার ৭০০ মানুষের প্রাণ বাঁচানো, নাকি একই টাকায় ৩ হাজার মানুষের প্রাণ বাঁচানো। লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের শিক্ষক টমাস ম্যাথ বলেছেন, ‘যাদের একটা স্থায়ী ঠিকানা আছে, তাদের বিকাশ কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না। আর যাদের প্রতিবছর বাড়ি বদলাতে হয়, ভেঙে আবার বানাতে হয়, তাদের বিকাশ পদে পদে বিঘ্নিত হবে।’

উপকূলের অর্থনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন আর পরিবর্ধন হবে, যদি মানুষ জলোচ্ছ্বাস–সহনীয় বাড়ি পায়। সহজ শর্তে বিনা সুদে ঋণ দিয়ে এ কাজটা করা যেতে পারে।


●গওহার নঈম ওয়ারা ই–মেইল: [email protected]