এক বুনো ফুলের মায়ায়

মায়াবী এক বুনো ফুল। কাপ্তাই অরণ্য থেকে।ছবি: লেখক

রাঙামাটির কাপ্তাই অরণ্যের রাম পাহাড়ের পাখি ও গাছের গল্প আমাকে শুনিয়েছিলেন বন্য প্রাণী গবেষক সুপ্রিয় চাকমা। তাঁর সঙ্গেই সেই বনে প্রথম যাওয়া ২০০৭ সালে। কর্ণফুলীর একহারা রূপ, হ্রদ ও পাহাড়ের সঙ্গে সবুজের মিতালি, সকালের কুয়াশা, পাখিডাকা বনের সন্ধ্যা দেখে দেখে মন ভরে গিয়েছিল আজ থেকে ১৪ বছর আগে! কিন্তু বনের সেই রূপ-লাবণ্য জমা রয়েছে স্মৃতির পাতায়। যখন মনে পড়ে, তখন স্মৃতির পাতাগুলো উল্টিয়ে রূপগুলো দেখে নিই।

যখন সময় ও সুযোগ হয়েছে কাপ্তাই বনে ছুটে গেছি, বনের পাখি ও ফুলের সঙ্গে দেখা করতে। এ বনের অনেক ফুলই মায়াবী। তাদের দেখতে হলে যেতে হবে বনের গহিনে। বনে হাঁটার তেমন পথ নেই, আবার হাতির ভয়ও আছে। যে কারণে এ বনের কয়েকটি ছড়া দিয়ে বন পর্যবেক্ষণ করতে সুবিধা হয়। ছড়ায় বর্ষায় জল থাকে বেশি; এরপরও হাঁটা যায়। হাঁটা পথে দেখা হয় নীলকান মাছারাঙা, উদয়ী বামনরাঙ্গা, সবুজ হাঁড়িচাচা, কাঁকড়াভুক বেজিসহ নানান প্রজাতির বন্য প্রাণীর সঙ্গে। ছড়া দিয়ে হাঁটলে বনের দুদিকের গাছপালাও দেখা যায়। দেখা যায়, জলের কাছে ও স্যাঁতসেঁতে পরিবেশে কী কী উদ্ভিদ জন্মে সেসব।

এক বর্ষায় এ বনের ছড়ার পথে দেখা হয়েছিল লবঙ্গলতা, বুনো কাঞ্চনসহ এক অচেনা লতার সঙ্গে। এমন মায়াবী রঙের বুনো ফুল সেই প্রথম দেখলাম। সিঁদুর লাল রঙের ফুল সবুজ পাতার সঙ্গে মিশে এক অনবদ্য দ্যুতি ছড়াচ্ছে বনের মধ্যে। লতানো আবেশে বেড়ে উঠেছে সে। ফুলের পাপড়ি দেখতে কিছুটা শিম ফুলের গড়ন। পরিবার ফ্যাবাসি তখনই নিশ্চিত হলাম। সুন্দর ফুলের এ উদ্ভিদের বৈজ্ঞানিক নাম Callerya cinerea। কিন্তু বাংলা নাম জানা নেই! যে কারণে কানাডাপ্রবাসী উদ্ভিদ অনুরাগী ও সংবাদকর্মী মায়া মাহজাবীনের দ্বারস্থ হলাম। তিনি আমাকে জানালেন, এটির নাম কাঞ্জ। হয়তো আরও কোনো স্থানীয় নাম থাকতে পারে।

এটি বহুবর্ষজীবী আরোহী গুল্ম। পাহাড়ি বনে জন্মে। শেরপুরের গারো পাহাড়ে এ লতাটি খুঁজে পেয়েছেন উদ্ভিদ অনুরাগী ফকীর শহীদ। কয়েক দিন আগেই আমাকে ছবি পাঠিয়েছেন নাম জানার জন্য। এটা নিয়ে লেখার বিষয়টি তখনই মাথায় এল। কাষ্ঠল এ লতা প্রায় ১০ মিটার হতে পারে। কাণ্ডের প্রস্থ প্রায় ১৫ সেন্টিমিটার। পত্রকে পাঁচটি পাতা থাকে। পুষ্পমঞ্জরি পেনিকেল। ফুলের দৈর্ঘ্য ১-১.৬ সেন্টিমিটার। ফুল ফোটে মে থেকে জুলাই মাসে। তবে ভৌগোলিক অবস্থানভেদে তারতম্য হতে পারে। ফল ধারণ ও বীজ পরিপক্ব হতে প্রায় নভেম্বর ছুঁয়ে যায়।

প্রধানত চিরসবুজ বনই আবাস। বাংলাদেশ, ভারত, চীন, ভুটান, মিয়ানমার, নেপাল ও থ্যাইলান্ডের বনে পাওয়া যায়। পাহাড়ের ঢালে, উপত্যকার প্রান্তে জন্মে এবং প্রায় ৩৫০ থেকে ২৫০০ মিটার উচ্চতায় দেখা যায়। দেশের বনে এটির সংখ্যা এবং বিস্তার নিয়ে কোনো গবেষণা নেই। তবে দুর্লভ বলা যেতে পারে। সিলেটের বনে দেখিনি। বিশ্বের নানা দেশের হার্বেরিয়ামে প্রায় ১০০ বছর আগের কিছু নমুনা সংগৃহীত আছে। অপার সুন্দর এ মায়াবী ফুলের উদ্ভিদ নিয়ে বিস্তারিত গবেষণা প্রয়োজন।